
ছবি: জনকণ্ঠ
ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আখিলা নদীর তীরে অবস্থিত একটি রহস্যময় স্থান— ডাকাত ভিটা। এক সময়ের নির্জন, জঙ্গলাকীর্ণ এই উঁচু ভূমি এখন শুধু একটি লোককাহিনীর কেন্দ্র নয়, বরং পর্যটন সম্ভাবনার এক অনন্য জায়গা।
‘ডাকাত ভিটা’ নামটি এলেই কৌতূহল জাগে— কে ছিল সেই ডাকাত? কেন এই জায়গার নাম ‘ডাকাত ভিটা’? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় বিস্ময়কর এক লোককাহিনী।
জনশ্রুতি অনুসারে, আজ থেকে প্রায় তিন-চারশ বছর আগে বরুকা গ্রামের কোনাপাড়ায় আশ্রয় নেয় এক শিশু (মতান্তরে এক মহিলা ও শিশু)। সেই শিশুর নাম হয় ফকির আলী। কিশোর বয়সে গরু কিনতে গিয়ে তার দেখা মেলে এক বৃদ্ধের সঙ্গে, যিনি বলেন— ফকির আলীর বাড়ির পাশে যে ‘ডাকাত ভিটা’ রয়েছে, সেখানে গুপ্তধন আছে এবং সেই ধনের প্রকৃত অধিকারী ফকির আলী নিজেই।
বৃদ্ধের কথামতো, ফকির আলী কাঁঠাল গাছের গর্ত থেকে গুপ্তধন উদ্ধার করে— এক অংশ দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন, আর এক অংশ দিয়ে হজ পালন করেন। বাকিটা দিয়ে তৈরি হয় তার ভবিষ্যৎ।
অন্য একটি সংস্করণে বলা হয়, হারিয়ে যাওয়া ফকির আলীকে উদ্ধার করে একদল ডাকাত। তার ঠিকানা জেনে তারা গোপনে তাকে ধনের খবর জানায় এবং পৌঁছে দেয় তার এলাকায়।
পুরনো কথিত বিশ্বাস মতে, ডাকাত ভিটার কাঁঠাল গাছটি ছিল জ্বিনের দখলে। অনেকেই বলেছেন, এর ডাল কাটতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। এমনকি কয়েক বছর আগে গাছটিতে রহস্যজনকভাবে আগুন ধরে যায়, তবুও এখনো সে গাছ বেঁচে আছে।
৬০-৭০ বছর আগেও যেখানে মানুষের বসতি ছিল না, সেখানে এখন ৮-১০টি পরিবার বাস করছে। আছে একটি ঈদগাহ মাঠ, রয়েছে একাশি ও মেহগনি গাছের সারি। তবে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আখিলা নদী এখন প্রায় মৃত।
লোককাহিনী, ইতিহাস ও রহস্যে মোড়ানো এই জায়গাটি হতে পারে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। পর্যাপ্ত উদ্যোগ, সংরক্ষণ ও প্রচার পেলে ‘ডাকাত ভিটা’ ফুলবাড়ীয়ার জন্য যেমন গর্বের বিষয় হতে পারে, তেমনি হতে পারে নতুন প্রজন্মের ইতিহাসচর্চার স্থান।
গবেষক ও লেখক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন: “নিঃসন্দেহে ‘ডাকাত ভিটা’ ফুলবাড়ীয়ার একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এটি শুধু একটি লোককাহিনীর কেন্দ্র নয়, বরং আমাদের লোকজ সমাজের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারক। এরকম জায়গাগুলোকে ঘিরে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব, যা একদিকে যেমন স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করবে, তেমনি নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত রাখবে।”
তিনি আরও বলেন, “যথাযথ গবেষণা, নকশা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এই স্থানকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যটনের মানচিত্রে যুক্ত করা সম্ভব। তবে একে সংরক্ষণ, সৌন্দর্যবর্ধন এবং নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজন স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ।”
লোককাহিনী বাস্তব হোক বা কল্পনা— ডাকাত ভিটা এখন কেবল ইতিহাসের অংশ নয়, এটি ফুলবাড়ীয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। হয়তো একদিন গাছটি হারিয়ে যাবে, কিন্তু যদি সংরক্ষণ করা হয়, তবে গল্পটি থাকবে ইতিহাস হয়ে, স্মৃতি হয়ে, পর্যটনের দৃষ্টান্ত হয়ে।
এম.কে.