ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ॥ সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে

বাজেটে দেশী-বিদেশী ঋণের চাপ কমানোর উদ্যোগ

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২২:১০, ১৩ মে ২০২৫

বাজেটে দেশী-বিদেশী ঋণের চাপ কমানোর উদ্যোগ

বাজেটে দেশী-বিদেশী ঋণের চাপ কমানোর উদ্যোগ

আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে দেশী-বিদেশী ঋণের চাপ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে রাজস্ব আদায়ের ওপর জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ঋণ জমা হয়ে যাওয়ায় সুদ পরিশোধের হার ক্রমে বাড়ছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রয়োজনীয় গবেষণা ছাড়াই ঋণ নিয়ে এমন কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা থেকে পর্যাপ্ত আয় হচ্ছে না।

এতে করে চাপে পড়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। এ অবস্থার উত্তরণ চায় বর্তমান সরকার। ফলে, বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে দেশী-বিদেশী ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে কম ঋণ নেওয়া হবে। চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা মোট বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আগামী অর্থবছরে এই ঋণের পরিমাণ আর বাড়ানো হচ্ছে না। 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের দেশী-বিদেশী ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুন শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত বছরের জুন শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকায়, চার বছর আগে যার পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা।

সেই হিসাবে চার বছরের ব্যবধানে বিদেশী ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০ কোটি টাকার মধ্যে নিট বিদেশী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ হাজার ৭০০ কোটি এবং দেশী বা অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। বাকি ঋণ অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের।
দেশী-বিদেশী ঋণের স্থিতি বেশি হওয়ার কারণে সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে আগামী বাজেটেও। চলতি অর্থবছরে সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা আগামী অর্থবছরে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় ১৬.৮ শতাংশ, যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য।

গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতা থেকে সরে এসে বাজেটের আকার কমিয়ে ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা যা, চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাজেট সংকোচনের প্রধান কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর সুদ পরিশোধে ব্যয়ের বড় ধরনের বৃদ্ধি। শুধু তাই নয়, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে তাতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

আবার ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা মূলত রাজস্ব সংগ্রহের অর্থ। আগামী অর্থবছরে এসব বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু সুদ পরিশোধের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে  যেতে পারে। এর সঙ্গে মূল ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ধরলে বাজেটের ওপর খরচের চাপ আরও বাড়বে। ঋণ পরিশোধে খরচ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় অন্যান্য খাতে খরচের সুযোগ কমছে।

খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন বাজেট ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ও পরিচালন বাজেট ২৮ হাজার কোটি টাকা বেড়ে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। তবে আগামী অর্থবছরে বেতন, ভাতা ও ভর্তুকির মতো খরচ চলতি অর্থবছরের মতোই অপরিবর্তিত থাকবে। বাজেট ঘাটতি জিডিপির পাঁচ শতাংশের নিচে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ৪ দশমিক ২ শতাংশ রাখা হতে পারে। বেশির ভাগ ঋণই নেওয়া হবে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, ধীরে ধীরে ঋণ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। তবে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সরকারকে এত বেশি ঋণ নিতে হতো না। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আগামী অর্থবছরে সরকার বেশি ঋণ হয়তো নেবে না, বরং সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি থেকে ভালো অর্থ সংগ্রহ করবে। তিনি বলেন, দেশীয় ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত চাপের মুখে পড়ে। উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যায়। ফলে, সংকুচিত হয় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। 
এদিকে ঋণের চাপ কমাতে উন্নয়ন খাতেও ব্যয় সংকোচন করা হচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রস্তাবিত আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। এটি গত চার অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

×