ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উদ্যোক্তা কোহিনূর এবং তার কর্মীবাহিনী

জলি রহমান

প্রকাশিত: ০০:৫৩, ২৬ মার্চ ২০২৩

উদ্যোক্তা কোহিনূর এবং তার কর্মীবাহিনী

এ বছর পাট দিবসে পাট ও পাট জাতীয় পণ্যের উৎপাদন

এ বছর পাট দিবসে পাট ও পাট জাতীয় পণ্যের উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধিতে অবদান রাখায় ১১ ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, চাষী ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এরমধ্যে পুরস্কারপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান তরঙ্গ। সম্পূর্ণ রপ্তানিনির্ভর এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কোহিনুর ইয়াছমিন জানালেন তার সাফল্যের কথা। পঞ্চাশোর্ধ একজন নারী কোহিনুর বেগমের বাবা ছিলেন ডাক্তার। মা স্কুলের শিক্ষক।

শখ করে চারটি মেশিন দিয়ে শুরু করা কাজ এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৩২০০ নারী পিছ হিসেবে সারা বছরই কাজ করছে। তরঙ্গের ঢাকা অফিসে রয়েছে ২৮০ জন নারী কর্মী যারা মাসিক বেতনভুক্ত। এসব নারীদের তৈরি পণ্য চলে যাচ্ছে ইতালি, আমেরিকাসহ নানান দেশে। রাজধানীর বাইরে যেসব নারী কাজ করছেন, তারা শারীরিক অথবা পারিবারিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত।

রয়েছে আধিবাসী নারী, স্বামী পরিত্যক্তা,  এসিডদগ্ধ এরকম ছয়টি ক্যাটাগরিতে নারীরা কাজ করছে তরঙ্গে। কোহিনুর ইয়াছমিন এসব নারীকে স্বাবলম্বী করতে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। তিনি কর্মীদের নিখুঁত কাজেরও অনেক প্রশংসা করলেন। মেশিনের থেকেও তাদের হাতের কাজ সুন্দর এমনটাই বললেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠানে। 
তিনি আরও বললেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট নারী বান্ধব। গ্রাম-গঞ্জের নারীরা অনেক কর্মঠ। তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে দেশ আরও উন্নত হবে। পাশর্^বর্তী বিভিন্ন  দেশ আমি ঘুরে দেখেছি তাদের থেকে আমাদের পণ্যের মান অনেক ভালো। তাই সরকারি সহযোগিতা পেলে এ শিল্প খাত থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। এ ছাড়া   বৈশি^ক অস্থিরতা কেটে গেলে এ খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলেও আশা প্রকাশ করলেন তিনি।
এ শিল্প প্রসারে কি করা প্রয়োজন প্রসঙ্গে বললেন, বৈচিত্র্যময় এ শিল্প নিশ্চিত প্রসারিত হবে। তবে তৈরি পোশাক শিল্পে যেভাবে সরকারি প্রণোদনাসহ নানাভাবে সাহায্য করা হয়, এই সেক্টরেও তেমনি নজর দেওয়া প্রয়োজন। তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল বিদেশনির্ভর। আর পাট শিল্প সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য। এখানে মূল্য সংযোজন কর নেই, তাই খরচ কম লাভ বেশি।
পাট একটি শ্রমঘন শিল্পখাত। বর্তমানে এ শিল্পে দেশের প্রায় ৪ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। পাটকে এক সময় বলা হতো সোনালি আঁশ। উন্নত জাতের পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি, নতুন নতুন পাটপণ্য উদ্ভাবন এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে এ খাতে কর্মসংস্থান প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রচলিত পাটপণ্যের (হেসিয়ান, স্যাকিং, সিবিসি) পাশাপাশি পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ডিজাইন ও লোগো সংবলিত পাটপণ্য তৈরি করে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের পাশাপাশি রপ্তানি করা হচ্ছে বিদেশেও। বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রার অর্জনও বাড়ছে ক্রমাগত। 
২০২১-২২ অর্থবছরে সারাদেশে কাঁচা পাট উৎপাদনের পরিমাণ সর্বমোট ৭০ দশমিক ৬৪ লাখ বেল। ২০২১-২২ অর্থবছরেই কাঁচাপাট রপ্তানি করে ২১৬ দশমিক ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯১১ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। উৎকৃষ্ট মাটি ও উপযুক্ত আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে বিশ্বের সেরা মানের পাট উৎপন্ন হয়।

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পাট রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত। জাতীয় রপ্তানি আয়ে পাট খাতের অবস্থান বর্তমানে একক কৃষিপণ্য হিসেবে দ্বিতীয়। দেশে প্রায় ১৭ লাখ একর জমিতে বছরে প্রায় ৯০ লাখ বেল পাট (তোষা, কেনাফ ও মেস্তা) উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে অধিকাংশই কাঁচাপাট হিসেবে রপ্তানি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাটখাত হতে মোট রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১১২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

পাট ও পাটশিল্পকে রক্ষা, পাটজাত পণ্যের উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার পাট আইন, ২০১৭ প্রণয়ন করেছে। পণ্য মোড়কীকরণে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার নিরুৎসাহিত এবং পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে মোড়কীকরণ আইন ২০১০ ও ব্যবহার বিধিমালা ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। বিশ্বব্যাপী পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার নিষিদ্ধের ফলে প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধি পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

এই সুযোগ কাজে লাগাতে পাট চাষী, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক, অ্যাসোসিয়েশন, নীতি নির্ধারকসহ সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি পাটকলগুলো পর্যায়ক্রমে বেসরকারি খাতে স্থানান্তরপূর্বক পুনরায় চালুকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশে ও বিদেশে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আরও নতুন নতুন পাটকল স্থাপিত হচ্ছে। এতে করে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং দারিদ্র্য বিমোচন হবে।

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব হবে। পাটের বহুমুখীকরণ ও পাটজাত পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের বিশেষ কার্যক্রমের ফলে পাটশিল্পে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।

×