ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

‎পুরুষের নিপুণ দক্ষতা দেখে সংসার বাঁধে ‎তাঁতি পাখি

তারেক মাহমুদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার,সদর, লক্ষ্মীপুর

প্রকাশিত: ১৩:২৮, ১৮ জুন ২০২৫

‎পুরুষের নিপুণ দক্ষতা দেখে সংসার বাঁধে ‎তাঁতি পাখি

ছবি: জনকণ্ঠ

‎নাম তার বাবুই। বুনন শিল্পী, কারুশিল্পী কিংবা তাঁতি পাখি নামেও ডাকেন অনেকে। দলবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত এই পাখিরা লোকালয়ের উঁচু গাছে বাস করতে পছন্দ করে। গ্রামীণ জনপদে এদের বেশি দেখা যায় তালগাছ কিংবা খেজুর গাছে। কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত করে রাখে পরিবেশ। আর এদের বাসার দিকে তাকালে মুগ্ধ না হয়ে থাকার উপায় নেই।

‎তাল গাছের ডালে ঝুলছে ঘাস ও লতাপাতা দিয়ে বানানো নান্দনিক ছোট্ট খুপরি ঘর। এ যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকা ঝুলন্ত বাড়ি। গ্রাম বাংলায় একটা সময় সহজেই চোখে পড়লেও এখন আর তেমন পড়ে না। বলছিলাম বুনন শিল্পী  বাবুই পাখির বাসার কথা। গাঁও-গ্রামে খুব সুন্দর নিপুণভাবে বাসা বোনে বলে এরা তাঁতি পাখি নামেও পরিচিত। বাবুই পাখির ইংরেজি নাম Black-breasted Weaver. লক্ষ্মীপুর জেলায় বাবুই পাখির দেখা মিলে গহীন চরে, তাও কম। 


‎গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এই বাসা নিয়ে একটা সময় প্রতিদিন খেলা করলেও শহরের মানুষের কাছে হয়তো অজানা। তবে কবি রজনীকান্ত সেন তার ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায় দারুণভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই তাঁতি পাখির সঙ্গে। পাখির বয়ানে গেয়েছেন স্বাধীনতার স্তুতি। ‘পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা/ নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা। 

‎বাবুই দৃষ্টিনন্দন পাখি। এদের বাসার গঠন বেশ জটিল আর আকৃতি খুব সুন্দর। কয়েক প্রজাতির বাবুই একাধিক কক্ষবিশিষ্ট বাসা তৈরি করতে পারে। বাবুই পাখিকে শৈল্পিক ইঞ্জিনিয়ার বা স্থপতিও বলা চলে।  নিজের ঘর সাজাতে তাদের কোনো জুড়ি নেই। এরা বেশ দলবদ্ধ প্রাণী আর কলোনি করে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। বেশিরভাগ বাবুই প্রজাতির পুরুষ সদস্য বেশ উজ্জ্বল রঙের হয়। কিছু প্রজাতি তাদের প্রজনন মৌসুমে বর্ণের ভিন্নতা প্রদর্শন করে। বাংলাদেশে তিন ধরনের বাবুই দেখা যায়। দেশি বাবুই, দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই।

‎নিপুন কারিগর ছোট্ট বাবুই পাখির বাসা উল্টানো দেখতে কলসির মতো। বাসা বানানোর জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয়া ঘাসের আস্তরণ ছাড়ায়। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে গোল অবয়ব মসৃণ করে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিক বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গাও তৈরি করা হয়। অন্য দিকটি লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ থাকে।কথিত আছে- বাবুই পাখি চালাকও কম নয়। রাতে বাসায় আলো জ্বালাতে জোনাকি পোকা ধরে এনে বাসায় গুঁজে রাখে।

‎বাবুই পাখি যত্ন করে তালপাতা, কাশবনের পাতা, খড়কুটো দিয়েই উঁচু তালগাছে, নারিকেল, কড়ই, খেজুর গাছে বাসা বাঁধে। বাসা যখন উঁচু তাল গাছে দোল খায়, তখন দারুণ লাগে। তাদের শৈল্পিক চিন্তা এতই প্রবল ঝড় কিংবা তুফানেও কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে না। এরা সাধারণত খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে।

‎মে থেকে সেপ্টেম্বর বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। পুরুষ বাবুই বাসা বোনে। বাসার কাজ অর্ধেক হলে স্ত্রী বাবুই তা দেখে, পছন্দ হলে জুটি বাঁধে। দুই থেকে চারটি ডিম দেয় স্ত্রী বাবুই। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে প্রায় দুই সপ্তাহ। বাচ্চা উড়তে শেখে ৩০ দিনের মধ্যে। এরা বীজ, ধান, ভাত, পোকা ও ঘাসজাতীয় খাবার খুঁটে খুঁটে খায়।

‎হালকা বাদামি ও কালচে হলদেটে বাবুইয়ের সেই কিচিরমিচির ডাক আজ আর তেমন একটা শোনা যায় না। নানা কারণে বিলুপ্তির পথে শৈল্পিক পাখি বাবুই।

‎ এরা লম্বায় ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৮-২২ গ্রাম। পুরুষ ও স্ত্রীর দেহের রঙে বেশ পার্থক্য আছে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষের দেহে রঙের যথেষ্ট পরিবর্তন হয়। পুরুষের মাথার চাঁদি সোনালি-হলুদ হয়ে যায়। কান-ঢাকনি ও গাল হালকা বাদামি থেকে সাদা। ঘাড় ধূসর-কালো ও গলা সাদা। বুকে চওড়া কালো ফিতা। পেট ফিকে সাদা, যাতে হালকা বাদামি বা হলদের ছোঁয়া। পিঠে কালচে লম্বালম্বি দাগ। প্রজননকালের স্ত্রী অন্য সময়ে চেয়ে কিছুটা উজ্জ্বল, অনেকটা শীতের পুরুষের মতো।

‎স্ত্রী ও প্রজননহীন পুরুষ মাথা ও ঘাড়ের ওপর কালচে ডোরা, যার মাঝখানে হলুদ। দেহের ওপরটায় লম্বালম্বি হলুদ ও কালচে দাগ। ভ্রু ও গলা হলুদ, কান-ঢাকনি বাদামি ও পেট পীতাভ। বুকের উপরের কালো ফিতা অসম্পূর্ণ। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে চোখ হালকা বাদামি, ঠোঁট কালচে। পা, আঙুল ও নখ হালকা গোলাপি।


‎চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বাবুই পাখি। একসময় গাছে গাছে দেখা মিলতো বাবুই পাখির বাসা। এই পাখি মূলত দুই ধরনের গাছে বাসা তৈরি করে- তাল গাছ ও খেজুর গাছ। এই দুই গাছই কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাসস্থান সংকটে এ পাখিও ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। 

‎প্রাকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য তাল গাছ ও খেজুর গাছ থাকা তাই খুবই জরুরি  বলে মনে করেন পাখি প্রেমীরা। বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট বাসা গ্রামে-গঞ্জে আগের মতো আর চোখে পড়ে না। খড়কুটো, তালপাতা, খেজুর পাতা, ঝাউ ও লতাপাতা দিয়ে বাবুই পাখি উঁচু তালগাছে বাঁধে মজবুত বাসা। প্রত্যেক তালগাছে ১০০ থেকে ১১০টি বাসা তৈরি করতে বাবুই পাখির সময় লাগে ৮-১০ দিন। প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা অক্ষত থাকে।

সাব্বির

×