ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

দেশের উন্নয়নে বড় বাধা দুর্নীতি

মো. জাহিদ হাসান

প্রকাশিত: ১৬:৫০, ১৮ জুন ২০২৫

দেশের উন্নয়নে বড় বাধা দুর্নীতি

কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক নীতিবহির্ভূত বা জনস্বার্থবিরোধী কাজই দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে একটি দেশের নানা কাঠামোর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হয়ে ওঠে না, বরং দেশ ধীরে ধীরে অবনতির দিকে চলে যায়।
লজ্জাজনক হলেও বলতে হয়, বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম একটি দুর্নীতিপূর্ণ দেশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০২৩ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০তম। ২০২২ সালে এই অবস্থান ছিল ১২তম। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে হাট-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে দুর্নীতি এত বেড়ে গেছে যে, এটি মানুষের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। জনগণের মনে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে যেকোনো সরকারি সেবা নিতে গেলে আগে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ দেওয়া এবং নেওয়া দুটোই অপরাধ। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই দুর্নীতিকারীরা কায়দা করে জনগণকে হয়রানির মধ্যে ফেলে ঘুষ আদায় করে। যেমন- অফিসের কোনো ফাইল আটকে দিয়ে ঘুষ গ্রহণ। এক্ষেত্রে অধস্তন সব কর্মকর্তারাও ঘুষ গ্রহণে প্রভাবিত হয়। এতে করে সাধারণ জনগণ পড়ে যায় ভোগান্তিতে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দুর্নীতি সবারই জানা ঘটনা। এর কারণে অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়। অযোগ্যতার কারণে তারা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এভাবেই যোগ্য জনশক্তির অভাবে পিছিয়ে পড়ছে দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প, যাতায়াত ব্যবস্থা, ক্রীড়াঙ্গন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো। সরকারি হাসপাতালে প্রায়ই চিকিৎসার জন্য অসচেতন মানুষের কাছ থেকে দালাররা টাকা হাতিয়ে নেয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি প্রতিবেদনের তথ্যমতে, যেসব পরিবার চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়েছে, তাদের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। গ্রামীণ এলাকায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৫১ শতাংশ। সেবা গ্রহীতা পরিবারের মধ্যে প্রায় ৬ দশমিক ২ শতাংশকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সময় ঘুষ দিতে হয়েছে, যার গড় পরিমাণ ছিল ৬৮০ টাকা। যানবাহনে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভুয়া টিকিট বিক্রি, নির্মাণ কাজে ভেজাল করে টাকা আত্মসাৎ করা প্রভৃতি চরম দুর্নীতির উদাহরণ। এসব কিছুর কারণে দেশের মানুষ ও সম্পদ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দায়িত্বে অবহেলা একটি বড় ধরনের দুর্নীতি। এসব দুর্নীতিবাজদের জন্য সাধারণ জনগণ তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয় এবং দেশ ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। শিক্ষকদের পাঠদানে অবহেলার কারণে শিক্ষার্থীরা সুশিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে যোগ্যতা ও দক্ষতার অভাবে বেকারে পরিণত হয়। জনসেবার জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি টাকা ও মালামাল আত্মসাৎ একটি বহুল আলোচিত দুর্নীতি। এর ফলে জনকল্যাণমুখী উন্নয়ন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বে অবহেলার কারণে দেশে সুশাসন  প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়ে ওঠে না। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং চাকরিতে দায়িত্বরতদের নানা দূর্ণীতির কারণে মেধাবীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়। বিগত সরকারের সময়ে কোটাব্যবস্থা এমন দুর্নীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া খাদ্য ও নিত্য পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে এবং পণ্য মজুদ করে চড়া দামে বিক্রি করে অসাধু ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি বাড়ছেই। এর ফলে ক্রেতারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। ঈদের সময় যানবাহনের টিকিট আটকে রেখে অধিক মূল্যে বিক্রি করে যানবাহন মালিকেরা জনভোগান্তির সৃষ্টি করে। রাস্তায় অনেক ট্রাফিক পুলিশ সামান্য কিছু টাকার জন্য গাড়িচালকদের অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়। এমন দৃশ্য হরহামেশাই আমাদের চোখে পড়ে। প্রশাসনের দুর্বলতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতি দেশে মাদক কারবারি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি। সরকার কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থায় দুর্নীতি রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বেশি হুমকিস্বরূপ। বিগত সরকারের আমলে সরকার, নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রশাসনের নানা দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক ক্ষতি সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। তিন মাসের তদন্ত শেষে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি একটি রিপোর্ট প্রদান করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। এতে দেখা যায় গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন বা এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে।
আমাদের দেশে দুর্নীতির নানাবিধ কারণ রয়েছে। মূলত টাকার লোভ এবং উচ্চাভিলাষী জীবন যাপন করার তীব্র আকাক্সক্ষা থেকে মানুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। আইনের অপপ্রয়োগ এবং বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা দুর্নীতি বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। দুর্নীতিকারীরা আইনের শাসনে বাধাপ্রাপ্ত না হওয়ায় বা ক্ষমতাবলে বিচারের মুখোমুখি না হওয়ায় এটি অবাধে বেড়ে চলেছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দুর্নীতির কারণ হলো তাদের অবৈধ পন্থায় ক্ষমতায় আসীন হওয়া এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব। দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তাদের মূল লক্ষ্য থাকে জনসেবার নামে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করা। এছাড়া ঘুষ দিয়ে যারা চাকরিতে নিয়োগ পায় তাদেরও লক্ষ্য থাকে ক্ষমতাকে পুঁজি করে ঘুষ নেওয়া। কোনো অফিসের প্রধান দুর্নীতিবাজ হলে সেই অফিসের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তারাও দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠে। এদের পরিবারের সদস্যদের চিন্তা-চেতনাতেও দুর্নীতি মিশে থাকে। পরবর্তীতে কর্মজীবনে গিয়ে এরাও দুর্নীতিবাজে পরিণত হয়। এভাবে দুর্নীতি সংক্রমণের মতো ছড়ায়। এছাড়া দুর্নীতি বৃদ্ধির বড় একটি কারণ হলো এর বিরুদ্ধে আইনের দুর্বলতা, জনগণের প্রতিরোধ না থাকা, কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং নৈতিক মূল্যবোধের অভাব।
দুর্নীতির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর কারণে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতির কারণে মেধাবীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং মেধার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে মানুষের সৃজনশীলতা বিনষ্ট হয়। এর কারণে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। দ্বন্দ্ব, সংঘাত, খুন, রাহাজানি প্রভৃতি বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হয়। দুর্নীতির কারণে দেশ আর্থসামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যার ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন সম্ভব হয়ে ওঠে না।
দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজন ব্যাপকভাবে গণসচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে দেশের গণমাধ্যমগুলো সহায়ক হবে। সেইসঙ্গে সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আয় ও ব্যয়ের হিসাব প্রদানের মাধ্যমেও দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক সচেতনতা ও আন্দোলন কর্মসূচি প্রভৃতি দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রধান উপায়। দেশের সরকার কাঠামোয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগ ঘটলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং পুরো দেশে দুর্নীতি কমে যাবে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক নির্বাচন ব্যবস্থা ও জনগণের সজাগ ভূমিকা। পরিবারে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার পাশাপাশি শিশুদের নৈতিকতার চর্চা শেখাতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার বিকাশ ঘটলে সমাজ থেকে দুর্নীতির অবসান ঘটবে। সাধারণ জনগণকে আইনের আশ্রয় নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ রুখে দাঁড়াতে হবে। ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে আমাদের দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠিত হয়। দুদকের আইন সম্পর্কে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পৃথিবীতে ধনী দেশগুলোর দ্রুত উন্নতির মূল কারণ হলো তাদের কাজে ন্যায্যতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা। দুর্নীতির অবসান ঘটলে আমাদের দেশেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এবং বাধাহীনভাবে দেশ এগিয়ে যাবে উন্নতির দিকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

প্যানেল

×