
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আজ প্রযুক্তির সুবিধা ভোগ করছে বটে, কিন্তু প্রশ্ন হলো- তারা কী ভাবছে, কী দেখছে, কোন পথে যাচ্ছে? দিনরাত সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তারা সময় দিচ্ছে, কিন্তু তার বিনিময়ে কিছু নিচ্ছে না- না জ্ঞান, না ইতিহাস, না মনন। ইনস্টাগ্রাম রিলস, টিকটক ভিডিও, ইউটিউব শর্টস- এসব নিয়েই যেন তারা আজকের ‘লাইফস্টাইল’ গড়ে তুলছে। মাথা নিচু, চোখ স্থির, কিন্তু ভিতরে ফাঁকা। এই ফাঁকা ভিতরই ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের তথ্য বলছে, দেশে এখন ১৩ কোটির বেশি মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী গোষ্ঠী তরুণরা। তাদের অনেকেই প্রতিদিন গড়ে ছয় থেকে আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করছে অনলাইন বিনোদনের পেছনে। কিন্তু এই সময় ব্যয় হচ্ছে মূলত ‘বিনোদনের’ নামে অগভীর, অস্থায়ী, মননহীন কনটেন্টে। অজস্র তরুণ আছে, যারা জানে না ১৯৫২ সালের আন্দোলনের মর্ম, ১৯৭১-এর যুদ্ধের রক্তঝরা গল্প, জানে না বাংলাদেশের সংবিধানে কী আছে, কিন্তু চোখ বন্ধ করে বলতে পারে কোন ট্রেন্ডিং মিউজিক এখন ইন, কার ভাইরাল ভিডিওতে কত মিলিয়ন ভিউ।
একটা সময় বাংলাদেশের তরুণরা রাজপথ কাঁপিয়েছে। তারা ভাষার জন্য গুলি খেয়েছে, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে। আর আজ? আজকের তরুণরা ঠোঁট নাড়িয়ে ট্রেন্ডে উঠছে, শিরোনাম ছুঁতে চায় শর্টস দিয়ে, আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে চায় অল্পবয়সী ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ হয়ে। এ কেবল সময়ের পরিবর্তন নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক পতনের লক্ষণ। এটি নিছক প্রজন্মের দোষ নয়, এটি গোটা সমাজব্যবস্থার দীর্ঘদিনের উপেক্ষা ও দায় এড়িয়ে যাওয়ার ফল।
পরিবার এখন সন্তানকে বড় করার বদলে তাকে সফল করার চাপে ব্যস্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুখস্থের বাইরে কিছু ভাবতে শেখায় না। রাষ্ট্র তরুণদের কাঁধে কেবল পরীক্ষার বোঝা তোলে, কিন্তু চিন্তার খোরাক দেয় না। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের সামনে রাখে কৃত্রিম গ্ল্যামারের উদাহরণ, দায়িত্ববোধ নয়। ফলে তরুণদের মধ্যে আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য, ইতিহাস, দেশপ্রেম- সব কিছুই ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। তারা বড় হচ্ছে, কিন্তু শেকড় হারিয়ে। তারা জানে না কে ছিল তিতুমীর, কার মাথায় গুলি লেগেছিল একুশে ফেব্রুয়ারিতে, কিন্তু জানে কোন ভিডিওতে কেমন ক্যাপশন দিলে রিচ বাড়ে।
তবে দায় কেবল মোবাইল ফোন বা প্রযুক্তির নয়। প্রযুক্তি কোনো দানব নয়। এটি একটি মাধ্যম। সমস্যা তখনই, যখন সমাজ এই মাধ্যম ব্যবহারের কোনো নৈতিক গাইডলাইন দেয় না। জার্মানি, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড- এসব দেশেও তরুণরা প্রযুক্তিনির্ভর। কিন্তু তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবার, সংস্কৃতিচর্চা এতটা সমৃদ্ধ যে তারা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। সেখানে প্রযুক্তি ‘উন্নয়নের হাতিয়ার’, আর এখানে সেটা হয়ে উঠছে ‘চিন্তাহীনতার চক্র’।
রাষ্ট্র কি কিছুই করছে না? করছে-কিন্তু দিকভ্রষ্ট। বাজেটে ডিজিটাল খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তরুণদের মানসিক বিকাশের দিকটিতে নজর নেই। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাসচর্চা শিক্ষাব্যবস্থায় গৌণ হয়ে গেছে। সংস্কৃতি, বিতর্ক, থিয়েটার, পাঠচক্র- এসবের জন্য প্রণোদনা নেই। বরং এসব করলেই বলা হয়, ‘এতে কী চাকরি হবে?’
সমাধান অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা কোনো একদিনে সম্ভব নয়। পাঠ্যসূচিতে চিন্তাশীলতা ও মানবিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্কুল-কলেজে সাহিত্য, বিতর্ক, নাট্যচর্চা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। পরিবারকে সন্তানদের সফলতার চাপে নয়, মানবিকতায় বড় করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতিনির্ভর ইতিবাচক কনটেন্টে সরকার ও গণমাধ্যমকে সহায়তা দিতে হবে। তরুণদের উৎসাহ দিতে হবে বই পড়তে, ভাবতে, প্রশ্ন করতে।
কারণ তরুণ মানে কেবল আগামী নয়- তরুণ মানে এখনকার সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবিক সত্তার ভিত্তি। এই ভিত্তি যদি রিলসনির্ভর হয়ে পড়ে, তাহলে ইতিহাস একদিন অবশ্যই প্রশ্ন তুলবে- এদের গন্তব্য ঠিক করার দায়িত্ব আসলে কার ছিল?
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ
প্যানেল