ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক পরিচালক রাইয়ান কবিরের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ১৭ জুন ২০২৫

সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক পরিচালক রাইয়ান কবিরের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ

ছবি: জনকণ্ঠ

সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক পরিচালক রাইয়ান কবিরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছেন ব্যাংকের একজন গ্রাহক। সোমবার দুদকে আবেদনটি করেন ব্যাংকটির গ্রাহক শিমুল সর্দার। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। 


দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, নিয়ম বহির্ভূতভাবে পরিচালক হওয়ায় সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ২০২২ সালের ৩১ মে তাকে পর্ষদ থেকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে কবিরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনেক অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাকে পর্ষদ থেকে অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

 


অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৫ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। কোনও উদ্যোক্তা না হয়েও ২০০২ সালে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হন রাইয়ান কবিরের বাবা আলমগীর কবির। ২০০৪ সালে তিনি চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিয়ে ২০ বছর ছিলেন। ছেলে রাইয়ান কবির ২০০৩ সালে ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগে চাকরিতে নিযুক্ত হন। তাকে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে পরিচালক বানিয়েছেন আলমগীর কবির। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, জালিয়াতি, দুর্নীতি এবং অর্থপাচারের মতো ঘটনা হাজারো গ্রাহকের আমানতকে শঙ্কায় ফেলেছে। বিধি বহির্ভূতভাবে ২০ বছর চেয়ারম্যানের পদে থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে লুটপাট করেছেন আলমগীর। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঋণ কেলেঙ্কারি, শেয়ার কারসাজিসহ বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের মাধ্যমে ব্যাংকটির হাজারো গ্রাহকের আমানতকে হুমকির মুখে ফেলেছেন। অনৈতিকভাবে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তার এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের বোর্ড সভায় পাস করিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সভায় কম সংখ্যক এজেন্ডা আলোচনা করা হলেও পরিচালকদের উপস্থিত দেখিয়ে সবগুলো এজেন্ডা পাস দেখান। আবার এজেন্ডার শেষ দিকে বিবিধ নামে একটা এজেন্ডা থাকে। যেখানে নিজের ইচ্ছামতো সব এজেন্ডা ঢুকিয়ে বোর্ড মিটিংয়ে পাস হওয়া মেমোতে নিজের পছন্দমতো পাতা পরিবর্তন করে নিতেন। তাতে মেমোর শর্ত, ঋণের পরিমান ও মেয়াদ পরিবর্তন করে দিতেন। এসব চলছে আলমগীর কবির ও তার ছেলের নির্দেশে। 


শিমুল সর্দার আবেদনে আরও উল্লেখ করেন, আলমগীর কবিরের পরিবার নিয়ন্ত্রিত বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (বিএলআই) থেকে ২০২০ সালে ১৫ অক্টোবরে মুনিরুজ্জামান সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক হন। তার আগে সাউথইস্ট ব্যাংক বিএলআই’র কোনও ঋণ ছিল না। ওই বছরের ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক এনওসি দেয়। কিন্তু সে সময় সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ২১০ কোটি টাকা ঋণ ছিল বিএলআই ক্যাপিটাল লি. এর, যা গুরুতর অপরাধ। ব্যাংকের কল মানির ১৩০০ কোটি টাকা থেকে শুধু বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (বিএলআই) ঋণ পায়। অথচ বিএলআই-এর বর্তমানে মোট প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে দেখানো হয় না বলেও অভিযোগ পর্ষদের। যা ব্যাংকিং খাতে গুরুতর অপরাধ। বিএলআই-কে আরও ১২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ১১৮৮ কোটি টাকা, পরিচালক হিসেবে বিএলআই-এর অংশ ২.৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৭ কোটি টাকা।

আইন অনুযায়ী পরিচালক বিএলআই শুধুমাত্র ১৩.৫ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য। অথচ বিএলআই প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা ভোগ করেছে। পাঁচ বছরে ঋণের বিপরীতে সুদ দিতে হবে না গ্রাহককে, এই বলে মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেন আলমগীর। তারপরও ওই ঋণের সুদ মুক্ত ব্লকড অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে তিনি জাজ ভূঁইয়াকে ৩০০ কোটি টাকা, সুয়াদ গার্মেন্টকে ১৫ কোটি, ফাহমী নিটকে ৩০০ কোটি টাকা, কেয়া গ্রুপকে ৯০০ কোটি টাকা, মাহাবুব স্পিনিংকে ১৫০ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে লিমিট ক্রাস করেছেন। তবে এই কারসাজির মাধ্যমে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে তিনি শত কোটি টাকা কমিশন নিয়েছেন বলে দাবি পর্ষদ সদস্যদের। 


এ ছাড়া রাইয়ান সিঙ্গাপুরে আর অ্যান্ড এন ট্রেড হোল্ডিংকে, ইএক্সচেঞ্জ সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লি. আর অ্যান্ড এন মেরিন অ্যান্ড শিপ ট্রেড প্রাইভেট লি. নামের তিনটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে প্রায় ২০ কোটি টাকার অধিক অর্থ শেয়ার মানি ইকুইটি হিসেবে বিনিয়োগ করেছেন। প্রতি বছর বিভিন্ন উপায়ে দেশ থেকে অর্থ পাচার করে কোম্পানিগুলোর নেট ইক্যুইটি বৃদ্ধি করছেন। যা রাইয়ান কবিরের আয় হিসেবে ঘোষণা নেই। বৈধ উৎসবিহীন এত বড় অঙ্কের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমতি ছাড়া অবৈধ পন্থার বিদেশে পাচার করা হয়েছে। 


পাশাপাশি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে লিজিংয়ের শেয়ার লেনদেনে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে আলমগীর কবিরকে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একই ঘটনায় তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগমকে পাঁচ কোটি টাকা ও জামাতা তুষার এল কে মিয়াকে আড়াই কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই তিন জনকে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। রাইয়ান নতুন করে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক হতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন। তিনি পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছেন। ২০২৫ সালের মার্চের ১১ তারিখে এ আবেদন করেন। এ অবস্থায় তাকে পুনরায় পরিচালক পদে নিয়োগ দিলে ব্যাংকটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাবে। তাই তাকে যেন বাংলাদেশ ব্যাংক দায়মুক্তি না দেয়। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গভর্নর, দুদক চেয়ারম্যান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ও এনবিআরের চেয়ারম্যানের সুদৃষ্টি কামনা করা হয় আবেদনে।

শিহাব

×