ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ধ্বংসের মুখে চারশ বছরের জোড়বাংলা মন্দির

হৃদয় হোসাইন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পাবনা

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ৩১ মে ২০২৫

ধ্বংসের মুখে চারশ বছরের জোড়বাংলা মন্দির

ছবি: জনকণ্ঠ

জোড়বাংলা মন্দির পাবনা জেলার সদর পৌরসভার অন্তর্গত ৪ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ রাঘবপুরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মন্দিরটি আনুমানিক চারশত বছরের পুরোনো। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মালিকানাধীন এই মন্দিরটি সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রায়—এমনটাই মনে করছেন অনেকেই।

ষোড়শ শতাব্দীর পর বাংলায় মন্দির নির্মাণের একটি পুনরুজ্জীবন দেখা যায়। পাবনার গোপীনাথ মন্দিরসহ জোড়বাংলা মন্দিরসমূহ ‘চালা’ শৈলীর অন্তর্গত। এই মন্দিরটিকে একটি নির্দিষ্ট কালানুক্রমিক কাঠামোর মধ্যে ফেলা কঠিন। তবে স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এটি উনবিংশ শতাব্দীর (১৮০১–১৯০০) মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয়। মুর্শিদাবাদের নবাবের তহশিলদার ব্রজমোহন ক্রোড়ী মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।

তবে মন্দির আবিষ্কারের সময় কোনো শিলালিপি পাওয়া না যাওয়ায় এর সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে আসামে ঘটে যাওয়া ৮.২–৮.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে পাবনাসহ আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে মন্দিরটির অনেক অংশ ভেঙে পড়ে। মন্দিরের সম্মুখভাগে খিলানের ওপর টেরাকোটা ফলকে রাম ও রাবণের সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের দৃশ্য অঙ্কিত ছিল, যা এখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত।

তৎকালীন অলঙ্করণে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনির চাক্ষুষ প্রতিফলন পাওয়া যেত। বর্তমানে বাম দিক ও কেন্দ্রীয় খিলানে অল্প কিছু পোড়ামাটির ফলক টিকে আছে। পুরোনো ছবির সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, উভয় পক্ষ তীর-ধনুক, তলোয়ার ও বর্শা নিয়ে যুদ্ধরত। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক ১৯৩০-এর দশকে তোলা ছবিতে দেখা যায়—কেন্দ্রীয় খিলানে টেরাকোটায় দশানন রাবণ রামের সেনার দিকে তীর নিক্ষেপ করছেন।

গোপীনাথের পূজার জন্য মন্দিরটি ‘গোপীনাথ মন্দির’ নামেও পরিচিত ছিল। রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি এখানে বিরাজমান ছিল বলেও জানা যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত এখানে পূজা-অর্চনা হতো এবং এটি একটি উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯১০ সালে গোপীনাথের মূর্তি স্থানীয় কালী মন্দিরে স্থানান্তর করা হয় এবং তখন থেকেই সেটি সেখানে আছে।

ভারত বিভাজনের পর মন্দিরটি দীর্ঘদিন অনাদরে পড়ে থাকায় স্তম্ভ, দেয়াল ও অলঙ্করণসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তান আমলে পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে মন্দিরটির একবার সংস্কার হয়েছিল। শহরের ঐতিহ্যবাহী কিছু পুরাতন স্থাপনার মধ্যে এটি অন্যতম।

বর্তমানে মন্দিরটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা প্রতিদিনই আসছেন। বহু প্রাচীন এই জোড়বাংলা মন্দিরটি সংরক্ষণ করে কালের সাক্ষী হিসেবে টিকিয়ে রাখার দাবি জানাচ্ছেন সচেতন নাগরিক ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

মুমু

×