
ছবি: জনকণ্ঠ
ব্রিটিশ শাসন আর নেই, কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে জমিদারদের প্রতাপ। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কেবল টিকে আছে তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনাগুলো। তেমনই এক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে অবস্থিত ‘মহেড়া জমিদার বাড়ি’। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও যুগের পর যুগ ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার এই অনন্য নিদর্শন।
রাজধানীর কাছাকাছি টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে এবং মির্জাপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে, প্রায় আট একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই মহেড়া জমিদার বাড়ি। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক থেকে উত্তরে এবং মির্জাপুর সদর থেকে পশ্চিমে, উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্রে এটির অবস্থান।
জানা যায়, ১৮৯০ দশকের পূর্বে স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা নামের দুই সহোদর কলকাতা থেকে লবণ ও ডালের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে মহেড়া গ্রামে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা এই সুবিশাল বাড়ি নির্মাণ করে জমিদারি প্রথা শুরু করেন।
তাদের আর্থিক প্রভাব বাড়তে থাকে, এবং গ্রামের দরিদ্র মানুষদের দাদন খাটাতে শুরু করেন। কেউ দাদনের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে শাস্তির সম্মুখীন হতেন—সম্পত্তি বা জমি পর্যন্ত নিলামে উঠতো। পরবর্তীতে উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারি প্রথা আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে কালীচরণ ও আনন্দ সাহার উত্তরসূরিরা করটিয়ার চব্বিশ পরগনার জমিদারদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে জমিদারি সম্প্রসারণ করেন।
তবে তাদের উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র রায় চৌধুরীর সময়ে গ্রামের রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যালয় স্থাপন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক কাজও করা হয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় অধিকাংশ জমিদার ভারতে পাড়ি জমান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী এই জমিদার বাড়িতে হামলা চালায় এবং কুলবধূসহ পাঁচ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাকিরা লৌহজং নদী দিয়ে নৌপথে দেশত্যাগ করেন।
পরবর্তীতে এখানে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান জমিদার বাড়িটিকে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে রূপান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নান এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ১৯৯০ সালে এটি পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে উন্নীত হয়।
মহেড়া জমিদার বাড়ির প্রবেশপথের সামনে রয়েছে বিশাল এক দিঘি, যার নাম ‘বিশাখা সাগর’। এর দক্ষিণ পাশে রয়েছে আম্রকানন, এবং প্রধান তিনটি ভবনের পাশেই রয়েছে নায়েবের ঘর, কাছারি ঘর ও গোমস্তাদের ঘর। কারুকার্যমণ্ডিত দুটি সুরম্য প্রবেশদ্বার, দেশি-বিদেশি ফুলগাছ ও বাহারি রঙের সাজসজ্জা বাড়ির শোভা বাড়িয়েছে।
মহেড়া জমিদার বাড়ির মূল আকর্ষণ চারটি ভবন: চৌধুরী লজ, মহারাজা লজ, আনন্দ লজ ও কালীচরণ লজ। চুনাপাথর, সুরকি ও ইটের সমন্বয়ে তৈরি এই ভবনগুলো যে কারো নজর কাড়ে।
পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য বিগত বছরগুলোতে ভবনের রঙ পরিবর্তন, মিনিপার্ক, চিড়িয়াখানা, পিকনিক স্পট ও রাতযাপনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এটি সিনেমার শুটিং স্পট হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
ঢাকা থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত এ জমিদার বাড়িতে মাত্র ৮০ টাকা প্রবেশ মূল্যে যে কেউ ঘুরে যেতে পারেন দেশের অন্যতম সেরা এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন।
মুমু