
ছবি: জনকণ্ঠ
এক সময় অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করতেন সাদিনা বেগম। সবার অবহেলার পাত্র ছিলেন তিনি, আর দিন কাটাতেন অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে। অর্থের অভাবে অনেক সময় খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। সেই বঞ্চনা, অবহেলা আর অভাবের সাগর পেরিয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বরিশাল ইউনিয়নের ভবানীপুর ডিলারপাড়া গ্রামের এই নারী এখন শুধু নিজের গ্রাম নয়, পুরো ইউনিয়নের হাজারো বঞ্চিত নারীর জন্য হয়ে উঠেছেন মুক্তির প্রতীক। নিজের কঠোর মনোবল, পরিশ্রম আর একাগ্রতা সাদিনাকে দিয়েছে সফল উদ্যোক্তার স্বীকৃতি।
তাঁর স্বপ্ন কেবল নিজের ভাল থাকা নয়। নিজের অভাবের সংসার থেকে উঠে এসে তিনি গাইবান্ধার প্রত্যন্ত গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি হস্তশিল্প কারখানা। যেখানে তার মতো ভাগ্যবিড়ম্বিত নারীরা পেয়েছেন কাজের সুযোগ। এক সময়ের আর্থিক ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার সাদিনা বেগম এখন নিজের জীবনে ফিরিয়েছেন আর্থিক সচ্ছলতা এবং ছয় শতাধিক হতদরিদ্র নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে জেলায় সৃষ্টি করেছেন অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত।
গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত নারীরা সাদিনার কারখানায় প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানে কাজ করছেন এবং আয়-রোজগার করছেন। তাঁদের হাতে তৈরি বাজারের ব্যাগ জেলার সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। সাদিনা বেগম পেয়েছেন সফল উদ্যোক্তার পরিচিতি।
তবে সাদিনার সফলতার এই পথ ছিল না সহজ। ৩৭ বছরের জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে তাঁকে। ২০০৮ সালে পলাশবাড়ীর ভবানীপুর ডিলারপাড়া গ্রামের মোনারুল ইসলামের (৪২) সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। একদিন পাশের গ্রামে ব্যাগ তৈরি করতে দেখেন সাদিনা। তখনই চিন্তা করেন এই কাজ করার। শুরুতে পুরনো বস্তা কেটে বাজারের ব্যাগ তৈরির চেষ্টা করতে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) থেকে ব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ নেন এবং কারিগরি জ্ঞান অর্জন করেন।
প্রথমে মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে নিজের উদ্যোগ শুরু করেন তিনি। পরে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কাজের পরিধি বাড়ান। পা-চালিত সেলাই মেশিনসহ ব্যাগ তৈরির উপকরণ কিনে নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলেন কারখানা। ধীরে ধীরে ব্যাগের চাহিদা বাড়তে থাকলে গ্রামের আরও কয়েকজন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগান। বর্তমানে তাঁর কারখানায় প্রায় ছয় শতাধিক দরিদ্র নারী কাজ করছেন। সাদিনার এ উদ্যোগ গ্রামীণ নারীদের জন্য খুলে দিয়েছে কর্মসংস্থান ও সম্ভাবনার দুয়ার।
ডিলারপাড়া গ্রামের একাধিক নারী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘‘গ্রামে কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় সংসার চালানো কঠিন ছিল। সাদিনার কারখানায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমরা নিজেরাই আয় করছি। দিনে ২০০-৩০০ টাকা করে আয় হয়। এই টাকা দিয়েই এখন ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছি।’’
গ্রামে থেকেই কাজ করে সংসারের জন্য অর্থ উপার্জন করতে পেরে আঞ্জুয়ারার মতো অনেকেই এখন নিজেদের উপার্জনে গর্ববোধ করছেন।
সাদিনা বেগম বলেন, ‘‘দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে পাইনি। এখন ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি, সংসারে এনেছি সচ্ছলতা।’’ তাঁর কারখানায় তৈরি ব্যাগ এখন রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, নীলফামারী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। প্রতি মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় অর্ধলাখ টাকা আয় হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘‘শুধু নিজে ভালো থাকতে চাই না। চাই না, গ্রামের কোনো নারী যেন আর বঞ্চিত হয়ে বাঁচে। তাই কাজের পরিধি আরও বাড়াতে চাই। সরকারের সহযোগিতা পেলে কারখানা বড় পরিসরে চালাতে পারব এবং উৎপাদন বাড়িয়ে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে পারব।’’
পলাশবাড়ী উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘সাদিনা বেগমকে উপজেলা বিআরডিবি অফিস থেকে ঋণসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে।’’
মুমু