
..
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি যাঁর কবিতা থেকে, গান থেকে নিত্য দিন শক্তি সাহস সঞ্চয় করেছে, যিনি ছিলেন উদার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচিন্তার অনুপ্রেরণা, সেই কবি কান্ডরি সাম্য ও মানবতার উচ্চ কণ্ঠ কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণবার্ষিকী আজ ১২ ভাদ্র মঙ্গলবার। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে পৃথিবী থেকে চির প্রস্থান করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। ৪৮তম প্রয়াণবার্ষিকী আজ জাতীয়ভাবে সারাদেশে পালিত হবে।
জীবদ্দশায় বিদায়ী বার্তা দিয়ে অভিমানী নজরুল লিখেছিলেন, ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,/ কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।’ বাংলা সাহিত্য সংগীতের ভান্ডারকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করে সত্যি সত্যি বড় একাকী নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন কবি। তবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও, তাঁর অমূল্য সৃষ্টির আলোয় এখনো পথ দেখে চলেছে বাঙালি।
বহু প্রতিভার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম বড্ড পরাধীন সময়ে ঝড়ের মতো, ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। কবির ভাষায় : ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনর্মহাবিপ্লব হেতু/এই ¯্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।’ তাঁর এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।’ প্রেম দ্রোহের দ্বৈতসত্তায় নিজেকে গড়েছিলেন। সাম্যের মানবের এবং মানবতার কবি ‘অপমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ বুকে ধারণ করেছিলেন। সারা জীবন ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলা ‘দুখু মিয়া’ আজও তাই সমান প্রাসঙ্গিক।
কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম হাতে যে প্রতিবাদ গড়েছিলেন, আজও তা ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কবির গান কবিতা বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। এ কারণে ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে বিদ্রোহী কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন তিনি।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সাম্যের কথা বলে। মানবতার কথা বলে। ধর্ম ও জাত পাতের নিকুচি করেছেন কবি। ধর্মের নামে অধর্ম, জাতের নামে বজ্জাতির শ্রেষ্ঠতম প্রতিবাদ তাঁর কবিতা ও গান। কবি ‘মানুষ’ পরিচয়টিকে রেখেছেন সবকিছুর ওপরে। তাঁর ভাষায় : ‘জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্ম সম সহনশীল,/তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।/যে জাত-ধর্ম ঠুন্কো এত,/আজ নয় কাল ভাঙবে সে তো,/ যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া...।’ মানুষের পক্ষে, মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়া কবি নারীর প্রতিও ছিলেন দারুণ শ্রদ্ধাশীল। তাই তো তিনি লিখতে পারেন, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
কাজী নজরুল ইসলামের নিজের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গেছেন। জন্মগ্রহণ করেছিলেন অতি দরিদ্র পরিবারে। মক্তবে পড়ালেখা দিয়ে শিক্ষা জীবনের শুরু। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। জীবিকার প্রয়োজনে এমনকি রুটির দোকানে কাজ করেন। তরুণ বয়সে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতিও। সাহিত্য চর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তোলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি লিখেছিলেন, ...আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল...।
কাছাকাছি সময়ে রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয় সর্বত্র।
নজরুল গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তাঁর প্রথম গদ্য ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনা নিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হৈনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’ তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সংগীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ার রেখে গেছেন কবি। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সংগীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তার সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়।
তবে জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল নানা লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। কবি লিখেছিলেন, ‘যবে উত্তের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না/বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত...। না, পৃথিবী থেকে অন্যায় দূর হয়নি। এখনো অত্যাচারিত হচ্ছে মানুষ। তবু ‘চির বিদ্রোহী বীর’ ‘চির-উন্নত শির’ কাজী নজরুল ইসলামকে শান্ত হতে হয়েছিল। মৃত্যু চিরতরে থামিয়ে দিয়েছিল তাঁকে। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল)। দীর্ঘ রোগ-ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
রাজধানীতে আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ ॥ আজ মঙ্গলবার সকালে কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে। বিভিন্ন সামাজিক সাস্কৃতিক রাজনৈতিক সংগঠন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হবে গভীর শ্রদ্ধা। বাংলা একাডেমিতে থাকবে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।