ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুই জনের মধ্যে একজন নারী কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার

প্রকাশিত: ১৯:৪৩, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

দুই জনের মধ্যে একজন নারী কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার

নারী জীবনে কোন না কোন সময় কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন।

কর্মস্থলে হয়রানি বলতে, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কর্মস্থলের সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোন জায়গায় বা যে কোনো উপলক্ষে কারও সঙ্গে আপত্তিকর বা অনাকাঙ্খিত কোনো আচরণ, মন্তব্য বা কর্ম বোঝানো হয়। অযথার্থ যৌন আচরণ, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং যৌন পীড়নও এর অন্তর্ভুক্ত।

অযথার্থ যৌন আচরণের মধ্যে রয়েছে অনুপযুক্ত মৌখিক এবং অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ করা, স্পষ্ট যৌন উপাদান সম্পর্কিত আচরণ এবং অবাঞ্ছিত শারীরিক সংযোগ অথবা যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব ইত্যাদি। বৈষম্যমূলক আচরণের মধ্যে পড়ে ব্যক্তির জেন্ডার পরিচিতি বা জেন্ডার অভিব্যক্তি এবং প্রকৃত বা ধারণাগত যৌন অভিমুখিতার ভিত্তিতে বৈষম্য করা অথবা একজন ব্যক্তিকে ট্রান্সজেন্ডার বলে অথবা সেরকম ধরে নিয়ে তার সঙ্গে বৈষম্য করা।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার জেন্ডার, ডাইভারসিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন স্ট্যাটিসিটিকস সেন্টার কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও হামলা সম্পর্কিত নতুন ডেটা টেবল প্রকাশ করেছে গত ফেব্রুয়ারিতে কানাডার সেন্টার ফর জাস্টিস অ্যান্ড কমিউনিটি সেফটি স্ট্যাটিস্টিকস- এর সহায়তায়।

যৌন হামলার অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের মধ্যে রয়েছে যৌন আক্রমণ; অনাকাঙ্খিত যৌন স্পর্শ এবং এমন কোন আচরণ যা কারসাজিমূলক, বল প্রয়োগ, নেশার ঘোর বা অশারীরিক কোনো উপায়ে বাধ্য করার কারণে ভুক্তভোগী তাতে সম্মতি দিতে অক্ষম ছিল।

দুই জনের মধ্যে প্রায় একজন নারী এবং ১০ জনের মধ্যে মোটামুটি তিনজনের মত পুরুষ কর্মস্থলে কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হন। কানাডায় ৩১ ভাগ পুরুষ এবং ৪৭ ভাগ নারী জীবনে কোন না কোন সময় কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন।

নারীদের সবচেয়ে বড় অংশ কর্মস্থলে অনুপযুক্ত যৌন আচরণের শিকার হন ৪৪ ভাগ, এর পরেই রয়েছে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হওয়া ২০ ভাগ এবং যৌন হামলার শিকার নারীরা ১৩ ভাগ। পুরুষদেরও উল্লেখযোগ্য অংশ কর্মস্থলে অনুপযুক্ত যৌন আচরণের শিকার হবার কথা জানান ২৯ ভাগ, বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হওয়ার কথা জানান ৯ ভাগ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন ৩ ভাগ পুরুষ।

কর্মচারীদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী ৬০ ভাগ নারী এবং ৩৯ ভাগ পুরুষ কর্মস্থলে যৌন হয়রানি বা হামলার শিকার হবার কথা জানান। প্রাথমিকভাবে এই পরিসংখ্যান চালিত হয় ২৫ থেকে ৩৪ বছরের নারীদের ৫৭ ভাগ এবং পুরুষদের ৩৭ ভাগ এর অনুপযুক্ত যৌন আচরণের শিকার হওয়ার হারের ভিত্তিতে।

তথ্য সংগ্রহের আগের ১২ মাসে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের ঘটনার ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে (যেসব ঘটনা ২০১৯ সালে ঘটে) দেখা যায়, ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারী ৩৯ ভাগ ও পুরুষদের ২৩ ভাগ অনুপাত তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। তবে সমীক্ষার আগের ১২ মাসে ২৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের কর্মস্থলে হয়রানি বা যৌন হামলার শিকার হওয়ার অনুপাত ছিল সর্বোচ্চ।

নতুন ডেটা টেবিলে প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু বিভিন্ন অভিবাসী সম্প্রদায় এবং অন্যান্য অভিবাসীদের মধ্যে হয়রানি অথবা যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতার তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে ৫৮ ভাগ নারী এবং ৪১ ভাগ পুরুষ কর্মক্ষেত্রে কখনও হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের মুখোমুখি হন বলে রিপোর্ট করেছেন। এদিকে প্রতিবন্ধী নন এমন ৪১ ভাগ নারী এবং ২৮ ভাগ পুরুষ কর্মস্থলে কোনও এক সময় যৌন পীড়নের সম্মুখিন হন।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কর্মস্থলে বাড়তি চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখিন হতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা এবং কর্মস্থলে বা তার বাইরে হয়রানি বা যৌন হামলার উচ্চ হার।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি বা যৌন পীড়নের শিকার হওয়া মানুষের হার নারীর ক্ষেত্রে ৪৩ ভাগ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৩০ ভাগ, আদিবাসী নন এমন নারীদের ৪৮ ভাগ এবং পুরুষদের ৩১ ভাগ জীবনের কোনও সময় কর্মক্ষেত্রে হয়রানি বা যৌন পীড়নের শিকার হয়েছেন বলে জানান। আদিবাসী নন এমন জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সংখ্যালঘু বিভিন্ন অভিবাসী সম্প্রদায় অথবা মূল ধারার শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী।

সংখ্যালঘু বিভিন্ন অভিবাসী সম্প্রদায়ের ৩৫ ভাগ নারী এবং ২০ ভাগ পুরুষ কর্মক্ষেত্রে হয়রানি অথবা যৌন হামলার শিকার হবার কথা জানান। অন্যদিকে মূল ধারার শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ৫১ ভাগ নারী ও ৩৫ ভাগ পুরুষ একই অভিজ্ঞতা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

অভিবাসী নারীদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের সামান্য বেশি ৩৪ ভাগ এবং পুরুষদের প্রতি পাঁচজনে একজন কর্মস্থলে হয়রানি বা যৌন পীড়নের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন বলে জানান। এদিকে কানাডায় জন্মগ্রহণকারী ৫২ ভাগ নারী এবং ৩৬ ভাগ পুরুষ জানান তারা কর্মস্থলে হয়রানি বা যৌন পীড়নের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।

এই ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, কর্মস্থলে হয়রানি বা যৌন পীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সামগ্রিকভাবে প্রতিবন্ধী লোকজন এবং নারীদের প্রতিনিধিত্ব বেশি। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়রানি, বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হওয়া মানুষের মধ্যেও প্রতিবন্ধী, নারী ও আদিবাসীদের অতিরিক্ত প্রতিনিধিত্ব থেকেছে ধারাবাহিকভাবে। এসব ফলাফল শুধু কর্মক্ষেত্রে যা ঘটে তার ওপরই আলোকপাত করে।

২০২০ সালে, লেসবিয়ান, গে বা উভকামী (এলজিবি) নারীদের মধ্যে ৭৬ ভাগ এবং পুরুষদের মধ্যে ৫৩ ভাগ কর্মস্থলে যৌন পীড়নের মুখে পড়েন। এদিকে শুধু বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আসক্তদের নারীদের অল্প অংশই ৪৬ ভাগ এবং পুরুষদের ৩১ ভাগ কর্মস্থলে হয়রানি বা যৌন পীড়নের শিকার হয়েছেন বলে জানান।

সমীক্ষার আগের ১২ মাসের কথা (২০১৯ সালে যেসব ঘটনা ঘটেছে) জিজ্ঞাসা করা হলে এলজিবি শ্রেণীর নারীদের ৬০ ভাগ এবং এলজিবি পুরুষদের ৩৭ ভাগ  কর্মস্থলে হয়রানি বা যৌন পীড়নের শিকার হওয়ার কথা জানান, অথচ বিপরীত লিঙ্গে আসক্ত নারীদের ২৭ ভাগ এবং পুরুষদের ১৮ ভাগ একই কথা বলেন।

জেন্ডার ভিন্নতার ভিত্তিতে সমগ্র কানাডায় সব ধরণের পেশা ও প্রতিষ্ঠানে কর্মক্ষেত্রে যে হয়রানি ও বৈষম্যের ঘটনা ঘটে সে বিষয়েও গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সমীক্ষা অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে মৌখিক অসদাচরণের শিকার হবার সম্ভাবনা পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি থাকে। এই মৌখিক অসদাচরণ হলো কর্মক্ষেত্রে হয়রানির সবচেয়ে প্রচলিত ধরণ।

একই সমীক্ষায় দেখা যায়, ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়, আর্থিক ও প্রশাসনিক, প্রাকৃতিক ও প্রায়োগিক বিজ্ঞান এবং এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশা, বিক্রয় ও পরিষেবা, শিক্ষা, আইন ও সামাজিক এবং সরকারী সেবায় নিয়োজিতদের চেয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক পেশায় জড়িত নারীদের কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হবার সম্ভাবনা বেশি। এতে আরও দেখা গেছে যে, সব পেশার নারীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বলেছেন, মক্কেল বা ক্রেতারাই যৌন হয়রানির মূল অপরাধী।

একই পরিস্থিতি দেখা গেছে কানাডার সশস্ত্র বাহিনীর নিয়মিত বাহিনীগুলোতেও, যেখানে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি সংখ্যায় যৌন পীড়ন, যৌনধর্মী ও বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন।

ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষের প্রাধান্য ছিল এমন পেশা যেমন, বিপণন, পরিবহণ ও যন্ত্রপাতি চালনা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশাগুলিতে কর্মরত নারীদের অনুপযুক্ত যৌনধর্মী আচরণের মুখে পড়ার সম্ভাবনাও বেশি।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার অন্য এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক উত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারীদের কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হবার সম্ভাবনা বেশি। “কর্মস্থলে যৌন অসদাচরণ ও জেন্ডার-ভিত্তিক বৈষম্য, ২০২০” শীর্ষক ওই ইনফোগ্রাফিক প্রকাশ করা হয় ২০২১ সালে। এতে আভাস দেওয়া হয় যে, আগের বছরে ২৫ ভাগ নারী ও ১৭ ভাগ পুরুষ কর্মক্ষেত্রে যৌন অসদাচরণের শিকার হন। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা জানায়, কর্মক্ষেত্রে অনাকাঙ্খিত যৌন আচরণের শিকার হবার সম্ভাবনা পুরষের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ। যৌন জেন্ডার বৈচিত্র্যের

অধিকারী লোকদের ক্ষেত্রে ২এসএলজিবিটিকিউ+ কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে হয়রানি বা যৌন পীড়নের লক্ষবস্তু হওয়ার সম্ভাবনা। তাদের সিসজেন্ডার এবং বিষমকামী প্রতিপক্ষের তুলনায় দুই থেকে চারগুণ বেশি। কর্মক্ষেত্রের বাইরেও পুরুষের চেয়ে নারীদের হয়রানি ও যৌন পীড়নের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা রিপোর্ট করেছে যে, নারীদের জনসমক্ষে অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের মুখে পড়ার সম্ভাবনা পুরুষের তুলনায় তিনগুণ বেশি, ১৫ বছর বয়স থেকে যৌন পীড়নের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা চারগুণ বেশি এবং অবাঞ্ছিত যৌন আচরণের শিকার হওয়ার কারণে নেতিবাচক মানসিক পরিণতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ বেশি। সেইসঙ্গে, অন্তরঙ্গ সঙ্গীদের হাতে সব ধরণের সহিংসতার সম্মুখীন হওয়ার বিষয়ে পুরুষের তুলনায় নারীদের রিপোর্ট করার সম্ভাবনা বেশি।

 

এম হাসান

×