ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১

গরিবের ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী

তালাবদ্ধ ওটিতে প্রাণের  সঞ্চার, আট মাসে  ৩২৫ অস্ত্রোপচার

এ রহমান মুকুল

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

তালাবদ্ধ ওটিতে প্রাণের  সঞ্চার, আট মাসে  ৩২৫ অস্ত্রোপচার

এক নারীর সিজারিয়ান অপারেশন করছেন সিভিল সার্জন ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী ও তার টিম

দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা অস্ত্রোপচার কক্ষে আলোর ঝলকানি আর চিকিৎসক ও রোগীর পদচারণায় পাল্টে গেছে জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর সার্বিক চিত্র। রুটিন মেনেই এখন প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হচ্ছে অস্ত্রোপচার। এসব অস্ত্রোপচার কক্ষের (ওটি) নানা সংকট বিদ্যমান থাকার পরও গত নয় মাস ধরে চার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সদর আধুনিক হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষ কর্মচঞ্চল থাকছে। অথচ এসব অস্ত্রোপচার কক্ষ (ওটি) পাঁচ বছর ধরে ছিল তালাবদ্ধ। কোনোটি নয় বছর। আবার কোনোটি কখনো খোলাই হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপিত অস্ত্রোপচার কক্ষ বছরের পর বছর এভাবে বন্ধ পড়ে থাকায় অবহেলা আর অযত্বে  মূল্যবান যন্ত্রপাতিও নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমনও দুর্দশায় তালাবদ্ধ অস্ত্রোপচার কক্ষগুলোকে সচল ও কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে এগিয়ে আসেন বর্তমান সিভিল সার্জন ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী। পঞ্চগড় সদর হাসপাতালের এক দল চিকিৎসককে নিয়ে টিম গঠন করে শুরু করেন অস্ত্রোপচার। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলা রোগীরা বিনামূল্যে এই সেবা নিতে পারছেন। অথচ কিছুদিন আগেও প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে গ্রামের গরিব রোগীদের সিজার ছাড়াও ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করাতে হতো।  
তালাবদ্ধ ওটিতে প্রাণের সঞ্চার ॥ নিউরো সার্জারির চিকিৎসক ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী পঞ্চগড়ে সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন গত বছর ১৩ জুলাইয়ে। এই জেলায় এসে তিনি জানতে পারেন, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে আটোয়ারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচার কক্ষ উদ্বোধন করা হয়। পরদিনই অবেদনবিদ বদলি হন। ফলে নতুন অস্ত্রোপচার কক্ষটি বন্ধ হয়ে যায়। আটোয়ারীর মতো বোদা, তেঁতুলিয়া ও দেবীগঞ্জের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অস্ত্রোপচার কক্ষ বন্ধ ছিল। তেঁতুলিয়ায় নয় বছর, বোদায় পাঁচ বছর ও দেবীগঞ্জে দুই বছর ধরে কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি। এই চিত্র নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু কারও কোনো টনক নড়েনি। জেলার সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল।   স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অস্ত্রোপচার কক্ষের এই বেহাল অবস্থায় পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের অবেদনবিদসহ অন্য চিকিৎসকদের নিয়ে জরুরি সভা করেন সিভিল সার্জন। সকলের কাছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে অস্ত্রোপচার (ওটি) চালুর বিষয়ে মতামত জানতে চান। সবাই ইতিবাচক সাড়া দিলে ওই বছরের আগস্টের মাঝামাঝি দেবীগঞ্জে প্রথম অস্ত্রোপচার চালু করা হয়। এর পর আর থেমে থাকেনি। একে একে বোদা, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তালাবদ্ধ অস্ত্রোপচার কক্ষে প্রাণের সঞ্চার শুরু হয়। 
সিভিল সার্জন যা বলেন ॥ পঞ্চগড় সিভিল সার্জন ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, সিভিল সার্জন হিসেবে এ জেলায় যোগদানের পর জানতে পারি কোথাও চিকিৎসক সংকট, কোথাও জনবল সংকট আর কোথাও সরঞ্জাম সংকট। আবার অনেক জায়গায় অস্ত্রোপচার কক্ষের যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি। সদর হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষ (ওটি) চালু থাকলেও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর ওটি রুম তালাবদ্ধ। এর পর নিজ উদ্যোগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত অনেক নার্সকে সদর হাসপাতালের ওটিতে এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি।  চিকিৎসক সংকটসহ দক্ষ জনবলের অভাবে প্রথমে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু সব চিকিৎসক সহায়তা করায় সেই সংকটও ধিরে ধিরে কেটে যায়। এখন সবার আন্তরিকতা আর দক্ষতায় রুটিন মেনে নিয়মিত অস্ত্রোপচার চলছে।
তিনি বলেন, প্রতি শনি, রবি ও সোমবার বোদায়, সোমবার দেবীগঞ্জে, মঙ্গলবার তেঁতুলিয়া ও বুধবার আটোয়ারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। তার নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার টিমে একজন অবেদনবিদ ও পঞ্চগড় থেকে চারজন চিকিৎসক রয়েছেন। এ ছাড়া স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিসকগণ তাদের সহায়তা করেন। 
নিত্যদিন সাত সকালে ছুটে চলে যে গাড়ি ॥ সিভিল সার্জনের গাড়িটি প্রতি সপ্তাহের শনি থেকে বুধবার পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছুটে চলে। নিত্যদিন সাত সকালে ছুটে চলা এই গাড়িতে সিভিল সার্জনের নের্তৃত্বে গঠিত অস্ত্রোপচার টিম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে অস্ত্রোপচার করছেন। সিভিল সার্জন  নিজেই রোগীর অস্ত্রোপচার করেন। তাকে সহায়তা করেন সদর হাসপাতালের অবেদনবিদ (কনসালট্যান্ট অ্যানেসথেসিয়া) ডাক্তার মনসুর আলম, ডাক্তার সিরাজউদ্দৌলা পলিন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি অ্যান্ড অব্) ডাক্তার আফিফা জিন্নাত, পঞ্চগড় সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার আবুল কাশেম, আটোয়ারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের (গাইনি অ্যান্ড অবস) ডাক্তার নাহিদ পারভীন, বোদা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের আবেদনবিদ ডাক্তার শাহ গোলাম তারেক রাফসানসহ অন্য চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত নার্সরা।
গরিবের ডাক্তার  খ্যাতি ॥ ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী পঞ্চগড়ে সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদানের পূর্বে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে যোগ দেন।

তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী সাগর কুমার মহন্ত জনকণ্ঠকে বলেন, ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী তারাগঞ্জে কর্মরত থাকাকালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরে ও সামনে ফুলের বাগান করেন। করোনাকালে সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে নানা সচেতনতামূলক কাজ করেছেন। তিনি গরিব ও দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি যাদের ওষুধ কেনার টাকা নেই তাদের নিজের পকেট থেকে ওষুধ কিনে দিয়েছেন। অল্পকিছুদিনের মধ্যে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন এবং গরিবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।  
আট মাসে রেকর্ড সংখ্যক অস্ত্রোপচার ॥ পঞ্চগড় সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চিকিৎসক ও অস্ত্রোপচার কক্ষের সরঞ্জাম সংকটের পরেও গত নয় মাসে ( ১৭ আগস্ট-২০২৩ থেকে ২৭ এপ্রিল-২০২৪ পর্যন্ত) জেলার চার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১৯ জন নারীর সিজারিয়ান এবং অন্যান্য ছোটখাটো অস্ত্রোপচার হয়েছে ১০৬টি। শেষ আট মাসে সিভিল সার্জন ডাক্তার মোস্তফা জামান চৌধুরী  সিজারিয়ান ও ছোটখাটো অস্ত্রোপচারসহ মোট ৩২৫টি অস্ত্রোপচার করেছেন। 
অস্ত্রোপচার সুবিধাভোগীরা যা বলেন ॥ তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়া গৃহবধূ হিমু আক্তার (১৯) জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি প্রথমবার মা হয়েছেন। প্রথমবার সন্তানের মা হওয়ায় যে খুশি হয়েছি তার চেয়ে বেশি খুশি বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার হওয়ায়। হিমু আক্তারের স্বামী হাসিবুল ইসলাম পেশায় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের শ্রমিক। বাংলাবান্ধার ঝাড়ুয়াপাড়ায় তাদের বাড়ি। তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার অস্ত্রোপচার না হলে ৫৭ কিলোমিটার দূরে পঞ্চগড়ে গিয়ে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হতে হতো। এতে ১৫/২০ হাজার টাকা খরচ হতো। তার স্বামীর পক্ষে এতো টাকা খরচ করা অসম্ভব ছিল। এখানে প্রায় সবকিছুই বিনামূল্যে পাওয়ায় যার পর নাই খুশি হিমু আক্তার ও তার পরিবার।


 

×