ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যাম্পাসের প্রথম বাংলা চ্যানেল জয়ী 

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ক্যাম্পাসের প্রথম বাংলা চ্যানেল জয়ী 

.

ম্যারাথন দৌড়ে সাফল্য অর্জনের পর কোনো এক অবসরে মুসা ভাবতে থাকেন নতুন কি করা যেতে পারে। হঠাৎ তার মাথায় এলো সাঁতারের কথা। সাঁতার নিয়ে বেশ কিছু ভিডিও দেখে ও রিসার্চ করে তিনি এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন অবধি কেউ বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেয়নি। তখন তিনি বেশ ব্যথিত হলেন। হঠাৎ, তিনি ভাবলেন সাঁতার কেটে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া গেলে মন্দ হয় না।
যেই কথা, সেই কাজ। ঢাকা থেকে সাঁতারের সরঞ্জাম কিনে নেমে পড়লেন অনুশীলনে। তীব্র শীতে যখন মানুষ কম্বলের মধ্য থেকে বের হয় না, সেখানে তিনি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে সাঁতার অনুশীলন করেছেন। শুরুতে, অল্প অনুশীলনে তিনি ক্লান্ত হয়ে যেতেন। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কঠিন-কঠোর ও নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনের ফলে, তিনি পানিতে একটানা তিন থেকে চার ঘণ্টা সাঁতার কাটতে সক্ষম হন।
মুসার বাংলা চ্যানেল সাঁতারের প্রস্তুতি শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে। সেখানে পানি স্বল্পতার কারণে তাকে বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধানে বের হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে পিয়ারপুরের কুমার নদে তিনি নিয়মিত সাঁতার অনুশীলন করেছেন। পুকুর ও নদের পানি বিশুদ্ধ না হওয়ায় তাকে চুলকানিসহ এলার্জিজনিত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। দমে যাননি। অনুশীলন চালিয়ে গেছেন। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। 
একসময়  মুসা বুঝতে পারেন স্পন্সর ম্যানেজ করতে না পারলে তার ইচ্ছা অঙ্কুরেই বিনাশ হবে। অনিশ্চয়তার কালো অন্ধকার যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। কখনোবা বাস্তবতা তাকে চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়েছে। আবার, কখনোবা ঘুমের মাঝে সেই অন্ধকার তাকে কু-লী পাকিয়ে দুঃস্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে গেছে। তবে তিনি ভয় পাননি। ঘুম ভাঙলে তিনি প্রোপোজাল লেটার নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন দিগি¦দিক। মুসা থামেননি। তিনি ছুটেছেন। দৌড়েছেন। হন্নে হয়ে খুঁজেছেন। দৌড়েছেন স্বপ্ন পূরণের পথে। আসলেই, স্বপ্ন তো সেটাই যা মানুষ জাগ্রত অবস্থায় দেখে। স্বপ্ন তো সেটাই যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। বাস্তবতা তাকে রক্তচক্ষু দেখালেও, সঠিক সময়ে দিয়েছে উপর্যুক্ত উপহার। অবশেষে, তিনি স্পন্সর পেয়েছেন। এবার মুসাকে আটকায় কে! 
মুসা অদম্য সাহস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে বাড়ি থেকে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। সেখানে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যায়। একটু বিশ্রাম নিয়ে মুসা নেমে পড়েন সাগরের জলে। এটাই তার প্রথম সাগরে সাঁতার কাটা। দুপুর গড়িয়ে যত বিকাল হয়, সমুদ্র তত উত্তাল হতে থাকে। বড় বড় ঢেউ কখনোবা তাকে অনেক উপরে তুলে নিয়ে যায়। আবার, কখনোবা তাকে আছড়ে ফেলে দিচ্ছে নিচের দিকে। ঢেউয়ের এই ছন্দ তাকে মাতিয়ে তুললেও, সমুদ্রের ভয়ংকর গর্জন তার মনে ভীতির সঞ্চার করে।
প্রতিযোগিতা শুরুর আগ মুহূর্তে মুসার অনুভূতি কেমন ছিল তা জানতে চাইলে মুসা উত্তর দেন যে তিনি বেশ নার্ভাস ছিলেন। যাদের সঙ্গে তিনি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে কেউ সাঁতারের প্রশিক্ষক। কেউবা দশ থেকে বারো বার বাংলা চ্যানেল জয়ী। আর নবীনদের মধ্যে অনেকের প্রস্তুতি তার থেকে ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুইমিং পুলের অনুপস্থিতি ও স্পন্সরের পেছনে  ছোটাছুটি না করতে হলে, তার প্রস্তুতি আরও ভালো হতো। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো সবার শেষে গন্তব্যে পৌঁছাবেন এবং সবাই তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। তবে কখনো হাল ছাড়ার কথা তিনি কল্পনাও করেননি। 
উত্তাল সাগরে সাঁতার কাটার সব থেকে বড় প্রতিকূলতা সম্পর্কে মুসা বলেন, ‘পানি না খেয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোই হচ্ছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। লবণাক্ত পানি শরীরে একবার প্রবেশ করলে, বমি হয়ে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। এতে দীর্ঘ সময় সাগরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পরে।’ মুসার কথা শুনে মনে পড়ে যায় স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের ‘দ্য রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’ সেই তৃষ্ণার্ত নাবিকের কথা। নাবিকের চারদিকে অথৈ পানি কিন্তু পান করার মতো সুপেয় একফোঁটা পানি কোথাও নেই। দীর্ঘ সাঁতারে মুসা পানি খেয়েছিল কি-না জিজ্ঞেস করলে মুচকি হেসে মুসা বলেন, ‘চায়ের কাপের এক কাপ পরিমাণ পানি খেয়েছি।’ রসিকতা করে তিনি আরও বলেন, ‘সেই পানি এখনো তার পেটে আছে।’
গন্তব্যে পৌঁছানোর মাত্র এক শ’ মিটার দূরে মুসা ভয়ানক এক বিপদে পড়েন। তিনি লক্ষ্য করেন সাগরের ঢেউ তার বুকের বরাবর পায়ের নিচ দিয়ে না গিয়ে, হাতের নিচ দিয়ে যাচ্ছে। মুসা অবাক হলেন। মাথা উপরে তুলে তিনি দেখলেন স্রোত তাকে উত্তর বিচে না নিয়ে ঠেলে দিচ্ছে পূর্ব বিচে। মিয়ানমারের দিকে। আর সেখানকার স্রোত মোকাবিলা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। এখানে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। নেটওয়ার্কের বাইরে নাটকটি যে সত্য দুর্ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত তা এখানেই ঘটেছিল।
মুসা খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন। তার সঙ্গে থাকা রেসকিউ টিম নৌকার ইঞ্জিন চালু করে সঠিক পথে ফিরলেও, দিক পরিবর্তন করতে পারেননি মুসা। যতবার তিনি নৌকাকে অনুসরণ করতে গিয়েছেন, ততবার তিনি পিছিয়ে পড়েছেন। তবে কি তীরে এসে তরী ডুবে যাবে? নৌকাচালক বারবার তাকে অনুপ্রেরণা দিতে চিৎকার করে বলেন, ‘আর একটু এগোলেই গন্তব্য।’ 
সমুদ্র জয় করে বাড়িতে ফিরলে মুসার বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘কি খবর, সমুদ্র বিজয়ী!’ বাবার চোখে তিনি একজন সমুদ্র বিজয়ী। একই সঙ্গে, তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বাংলা চ্যানেল জয়ী প্রথম শিক্ষার্থী। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে মুসা বলেন, ‘নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে সবার সামনে তুলে ধরতে পেরেছি এটাই আমার অর্জন। এ যাত্রায় অনেকের ভালোবাসা পেয়েছি এটাও কি কম পাওয়া! পুকুর, নদী, সাগর তো হলো  এবার লক্ষ্য এভারেস্ট জয়ের।’

×