ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

অস্থির ডলার বাজার

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০০:০০, ১০ মে ২০২৪

অস্থির ডলার বাজার

.

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার শর্ত পরিপালনের ফলে চাপ বাড়ছে জনজীবনে। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বাড়ছে কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ। টাকার বিপরীতে কয়েক দফায় ডলারের দাম বাড়ায় আমদানিকৃত সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে করে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সংস্থাটির শর্ত পালনে ব্যাংকের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এতে করে ঋণের বিপরীতে সুদহার বর্তমান ১৩ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, আগামীতে এই সুদহার ১৮-২০ শতাংশ হতে পারে। এর ফলে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া বাজেটে সব ধরনের ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। দেশে কৃষি খাত বিকাশ এবং রপ্তানি বাড়াতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়া হয়। সব ধরনের প্রণোদনা সংকুচিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা তুলে দেওয়া এবং নতুন নতুন খাতে করারোপের শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। এসব শর্ত পুরোদমে বাস্তবায়ন শুরু হলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও কঠিন হয়ে পড়বে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 
জানা গেছে, আইএমএফের ঋণের শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর কি ধরনের প্রভাব পড়ছে তা বা পড়তে পারে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এমনকি সরকারের মধ্যেও এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান সম্প্রতি জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, আইএমএফের দেওয়া প্রায় সব শর্ত পূরণ করা হয়েছে। তবে শর্ত পূরণ করতে গিয়ে মানুষের জন্য ভোগান্তি হয়Ñ এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না সরকার। আইএমএফের ঋণ এদেশ ও মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা হবে এবং হচ্ছে। ঋণের শর্ত পরিপালনের ফলে জনজীবনে তার প্রভাব কি রকম হয় সেটাও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সারাবিশ্বেই এখন অর্থনীতিতে সংকট চলছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংকট সবমিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে চাপ রয়েছে। এ অবস্থায় আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য ভালো। তবে সংস্থাটির শর্তপরিপালন করতে গিয়ে জনজীবনে অস্বস্তি তৈরি হবে। ইতোমধ্যে অর্থনীতির বেশকিছু খাতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের ঊর্ধ্বতন গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে এই চাপ আরও বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। ভর্তুকির চাপ সামলাতে হবে। তবে সেটি সহনীয়ভাবে।

তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ে আমাদের বড় দুর্বলতা আছে। কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায় করতে পারলে ভর্তুকির ওপর এত বেশি চাপ আসত না। আইএমএফের সব পরামর্শ মেনে চলার দরকার পড়ত না। কিন্তু তাদের পরামর্শে ডলারের দাম বাড়ানো হলো, সুদ করা হলো বাজারভিত্তিক। এসব শর্ত পরিপালনের ফলে জনজীবনে দুর্ভোগ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, আইএমএফের ঋণ পেতে মূলত পাঁচ ধরনের পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতির কাঠামো আধুনিক করা, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, বাণিজ্য পরিবেশ ভালো করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার সামর্থ্য বাড়ানো। এই পাঁচ ধরনের বিষয়ের মধ্যে মূল বিষয়গুলো হচ্ছে, সরকারের ভর্তুকি কমাতে হবে, যাতে সরকার বেশি অর্থ উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় করতে পারে। এজন্য সরকারকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানি ও সারের দাম বাড়াতে হবে। এই পাঁচ পণ্যেই সরকারকে বেশি ভর্তুকি দিতে হয়। সরকার এ কাজ সহজেই করে ফেলছে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর শর্তও রয়েছে। এজন্য নানা খাতে যেসব করছাড় দেওয়া হয়, তা কমাতে বলেছে আইএমএফ। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতকরণ, টাকার বিনিময় হার নমনীয়সহ অনেক শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। তবে অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। সরকার তাদের (আইএমএফ) এই শর্ত মেনে নিয়েছে এবং বছরে চার দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কীভাবে এই দাম সমন্বয় করা হবে, তার একটি পরিকল্পনাও দিয়েছে আইএমএফের কাছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী তিন বছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে বছরে ভর্তুকি ৮৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফ চায়, দাম সমন্বয় করে (বৃদ্ধি করে) বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ কমাতে। অর্থাৎ এই খাতে কোনো ভর্তুকি চায় না ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা এই সংস্থাটি। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে দাম বাড়িয়ে তা নিয়ে আসা হবে উৎপাদন খরচের সমান বা কাছাকাছি পর্যায়ে। এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৭ টাকার কিছু বেশি। তবে আইএমএফের পরামর্শ মেনে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে এ দর ১২ টাকার ওপরে নিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোক্তাপর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা, যা এখন প্রায় ৯ টাকা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে।

তাই এটি বছরে কয়েকবার বাড়ানো হলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে যাবে। এমনিতেই সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এত চাপ ভোক্তা নিতে পারবে না। বিদ্যুৎ খাতে মূল্য বৃদ্ধি করে পুরো ভর্তুকি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মূল্য বৃদ্ধি না করে বিদ্যুৎ খাতে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি আছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারের জন্য গলার কাঁটা। এ পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে ভর্তুকি কমানো যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ জনকণ্ঠকে বলেন, আইএমএফের কথা শুনলে জনগণের ওপর চাপ বাড়বে, এটি খুবই স্বাভাবিক। এখন কথা হচ্ছে, সরকার তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। কাজেই তাদের কথা তো শুনতেই হবে। এটি তো সরকারের নীতির দুর্বলতা। সরকার কেন এ ধরনের শর্তে ঋণ নিচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে জনগণ আরও দিশেহারা হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি, বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) পুনর্গঠন করা দরকার। সেখানে আলোচনা করে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 
জানা গেছে, তেল-গ্যাসে এখন ভর্তুকি নেই। আইএমএফের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সঙ্গেও আলাদা বৈঠক করেছে। পেট্রোবাংলা ও বিপিসি প্রায় একইভাবে আইএমএফকে জানিয়েছে, গ্যাস ও জ্বালানি তেলে নতুন করে ভর্তুকির চাপ নেই। তেলের দাম নিয়ে স্বয়ংক্রিয় যে পদ্ধতি (আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে দেশে বাড়বে, কমলে কমবে) চালু করার কথা আইএমএফ বলেছিল, তা হয়েছে। প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেলে আর কখনো ভর্তুকি দিতে হবে না। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধরে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে। এর অংশ হিসেবে সর্বশেষ গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম সরকার একবার বাড়ায়। জানা গেছে,  মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশে কর আদায় বিশ্বে সবচেয়ে কম। এর অন্যতম কারণ হলো কর অব্যাহতির পরিমাণ বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত ৯ শতাংশের নিচে। আইএমএফ এই অনুপাত কমপক্ষে ১২ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। এজন্য কর অব্যাহতি তুলে নিতে বলেছে সরকারকে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৩০টি শিল্প খাত কর অবকাশ সুবিধা পায়। এই সুবিধা চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আছে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি ও সার্ভিস সেক্টরে ২১টি খাত একই সুবিধা পাচ্ছে। সম্প্রতি এনবিআরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব খাত থেকে কর অব্যাহতি তুলে নেওয়ার প্রস্তাব করেছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বিনিয়োগ হ্রাস ও নতুন কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। 
এ ছাড়া ডলারের দাম একদিনে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। এর ফলে আমদানিকৃত সকল পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সর্বশেষ এর দায়ভার ভোক্তা বা দেশের জনগণকে বহন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক মো. সহিদুল হক মোল্লা বলেন, আইএমএফের ঋণ প্রয়োজন আছে। তবে সংস্থাটির বেশকিছু শর্ত পরিপালনের ফলে ভোক্তা সমাজ বেকায়দায় পড়বেন। বিশেষ করে সব ধরনের আমদানিপণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে।

এর ফলে ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে কৃষি যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হবে। দিনশেষে এর দায়ভার পড়বে ভোক্তার ওপরই। বর্তমান সরকার জনবান্ধব বাজেট প্রণয়নের কথা বলছে। তবে আইএমএফের এসব শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যাতে না বাড়ে সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরি করেন। তাই উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা যাতে নিরুৎসাহিত না হয়ে পড়েন সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের কারণে দেশে ধনী ও গরিবের বৈষম্য আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সম্প্রতি তিনি জানান, এ ঋণ পেতে ভর্তুকি কমানো ও আর্থিক খাতে সংস্কারসহ সংস্থাটির দেওয়া বিভিন্ন শর্ত মানতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ। ভর্তুকি অনেক সময় ভালো হয়, আবার খারাপও হয়। বিদ্যুৎ খাতে যে বিপুল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে তা বাদ দিয়ে কৃষকের কাছে সার, বীজ ও ডিজেলে ভর্তুকি বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় এমনকি আইএমএফের গবেষণায়ও দেখা গেছে, তারা বিশ্বের যেসব দেশে গেছে সেসব দেশের সব জায়গায় বিভিন্ন রকম কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হলেও বৈষম্য বাড়ে। 
অস্থির ডলারের বাজার ॥  আইএমএফ প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ত্যাগের আগেই অস্থির হয়ে পড়েছে ডলারের বাজার। সংস্থাটির পরামর্শে সর্বশেষ বুধবার ডলারের দাম বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে খোলা বাজারে ডলারের দর ১২৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের পাশাপাশি অন্যান্য মুদ্রার দামে বড় পরিবর্তন এসেছে। বৃহস্পতিবার  রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টন, ফকিরাপুল এলাকার মানি এক্সচেঞ্জগুলো ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। বুধবার  প্রতি এক ডলার কেনা রেট ছিল ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা, বিক্রি হয়েছে ১১৬ টাকায়। বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ১২৫ টাকা। আর কেনার ক্ষেত্রে যে যার মতো করে দর ঠিক করে দিচ্ছে এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার ক্রলিং পেগ বিনিময় হার পদ্ধতি চালু করেছে এবং ব্যাংকগুলোকে প্রায় ১১৭ টাকায় মার্কিন ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমতি দিয়েছে। নতুন বিনিময় হার পদ্ধতি চালু করায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এ পদ্ধতিতে প্রতি মার্কিন ডলারে ক্রলিং পেগ মিড রেট (সিপিএমআর) নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। তফসিলি ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছে এবং আন্তঃব্যাংক চুক্তিতে সিপিএমআরের আশপাশে মার্কিন ডলার ক্রয় ও বিক্রয় করতে পারবে। ক্রলিং পেগ হচ্ছে-দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে।

ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই ঋণের সুদ ও বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়ে আসছিলাম। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদ হারকে বাজারভিত্তিক করেছে। কিন্তু ক্রলিং পেগের নামে ডলারের যে দাম ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছে তার কারণে মূল্যস্ফীতি কতটা কম তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, এতদিন ডলারে দর ১১০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও ব্যাংকগুলো ১২০-২৩ টাকায় ক্রয় করেছে। এজন্য দেশে ডলারের মজুত বেড়েছে। কিন্তু এখন যদি ১১৬-১৮ টাকায় এটিকে আটকিয়ে রাখা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই ডলারের মজুতে টান পড়বে। অর্থাৎ কম দরে ডলার কিনতে শুরু করলে বৈধ পথে ডলার আসা কমে যাবে। ডলারের মজুতও কমে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হওয়ার পাশাপাশি ডলার বাজারে আবারও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এদিকে ডলারের দর হঠাৎ করে বাড়িয়ে দেওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাদের অধিকাংশই বলছেন, ডলারের দাম এক ধাপেই ৭ টাকা বাড়ানোয় দ্রব্যমূল্যের ওপর প্রভাব পড়বে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। অধিকাংশ নিত্যপণ্যই আমাদের আমদানি করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের দর বাড়ানো হয়েছে। এতে আমদানি খরচ নিশ্চিতভাবে বাড়বে। আর আমদানি খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তিনি বলেন নিত্যপণ্য চাল, চিনি, আটা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও মসলাপাতির দাম বাড়বে। 
নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে ॥ ডলারের দাম বাড়া এবং ব্যাংক সুদের হার বাজারভিত্তিক করায় এর প্রভাব পড়বে নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতিবিদরা। ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মওলা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক হঠাৎ করে কেন ডলারে ৭ টাকা করে বৃদ্ধি করেছে, তা বুঝলাম না।

আমরা যেহেতু বেশিরভাগ নিত্যপণ্যই আমদানি করি সেহেতু আমদানি পণ্যে নিঃসন্দেহে বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর। আমরা তো বেশি টাকায় পণ্য কিনলে বেশি দামে বিক্রি করব। এতে ভোক্তা বা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। তবে যারা রপ্তানি করবে তারা হয়তো কিছুটা উপকৃত হবেন। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাজারভিত্তিক করায় ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির জন্য ভালো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এই নীতিতে কতদিন অটল থাকতে পারবে, তা নিয়ে সন্দিহান তারা। এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা ৯ শতাংশ সুদ বিবেচনা করে ব্যবসার পরিকল্পনা ঠিক করেছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক সেখান থেকে স্মার্টের নামে সুদের হার ১৪ শতাংশে নিয়ে গেছে। এখন আবার বাজারভিত্তিক করেছে। অর্থাৎ সুদের হার আরও বাড়বে, এটায় কোনো সন্দেহ নেই। সুদের হার বাড়ার ফলে  দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।

×