ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সফল পাঁচ নারীর গল্প

প্রকাশিত: ১৯:৫৮, ৯ মে ২০২৪

সফল পাঁচ নারীর গল্প

.

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মংলাবন্দর পরিচালক কালাচাঁদ সিংহ এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (সার্জারি) ডা. জওহর লাল সিংহ মা শ্রেষ্ঠ জননী হিসেবে সম্মাননা পেলেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন- বাবুল সরদার

বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার পাঁচজন সংগ্রামী নারীকে সম্প্রতি শ্রেষ্ঠত্বের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। এই পাঁচ নারীর মধ্যে চারজনই বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে অসহনীয় জীবনযাপন করেন। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জননী সম্মাননা পান নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মংলাবন্দর পরিচালক কালাচাঁদ সিংহ এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (সার্জারি) ডা. জওহর লাল সিংহ মা। পরিবার সমাজের নানা নির্যাতন, প্রতিকূলতা পেরিয়ে সফলতা অর্জনকারী এই পাঁচ নারীকে আনুষ্ঠানিকভাবেশ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা-২০২৩দেয় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। সোমবার (২২ এপ্রিল, ২০২৪) চিতলমারী উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান জানান, নারীদের অগ্রগামী করার জন্য সরকার জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় উপজেলার শ্রেষ্ঠ পাঁচজনকে সম্মানজনক এই পদক দেয়। এই পাঁচ নারীর জীবনসংগ্রামে সফল হওয়ার গল্প হৃদয়স্পর্শী শিক্ষণীয়।

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী

বাল্যবিয়ে হয় মিনারা হোসেন রেখার। দুই বছর পর পুত্রসন্তান জন্মদানে সংসারে কদর বাড়ে। রেখা কলেজে ভর্তি হন। এইচএসসি পাশ করেন। এরপর দ্বিতীয় সন্তান হয়। স্বামী বেকার। শ্বশুর-শাশুড়ির নানা কটুকথা শুনতে হয়। খালাতো বোনের কাছ থেকে ব্লক-বাটিক অ্যাম্বুসের প্রশিক্ষণ নেন। ২০০০ সালেগণমিলনএনজিওতে ব্লক-বাটিক নকশী সেলাই প্রশিক্ষক হন। তার স্বামী লোন নিয়ে মোটরসাইকেল কিনে ভাড়ায় চালাতে থাকেন। একদিন ছিনতাইকারীরা তার স্বামীকে মারধর করে মোটরসাইকেলটা নিয়ে যায়। দীর্ঘ এক বছর চিকিৎসার পর স্বামী সুস্থ হন। স্বামীর চিকিৎসা লোনের টাকা পরিশোধ করতে শ্বশুরবাড়ির জমি বিক্রি করে দেন। রেখা নিজের বসতঘরে ২০১০ সালে পার্লার শুরু করেন। চিতলমারীতে এটা প্রথম পার্লার। পার্লারের পাশাপাশি নকশী কাজের পোশাক কসমেটিক্স বিক্রিতে প্রতিদিন ১৫শথেকে দুই হাজার টাকা আয় হয়। পার্লারে বর্তমানে ছয়জন শিক্ষানবিশ মেয়ে কাজ করে। এখান কাজ শিখে মেয়েরা শহরের পার্লারে কাজ যায়। কেউ ব্যক্তিগত পার্লার খুলে স্বাবলম্বী হয়েছে। রেখা নিজেও আর্থিকভাবে সফল।

শিক্ষা চাকরি ক্ষেত্রে সফল নারী

দিপ্তী বসুর ছোটবেলায় তার বাবা দেনার দায়ে ভারতে চলে যান। অভিভাবকহীন সংসার। অভাব, পাওনাদার কারেন্ট সুদ ব্যবসায়ীদের চাপের মধ্যেও দিপ্তী প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে থাকে। তার মা সিদ্ধান্ত নেন সন্তানদের নিয়ে ভারতে যাবেন। দিপ্তী তখন এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন। মা-ভাইয়ের সঙ্গে ভারতে যেতে রাজি না হয়ে এইচএসসিতে ভর্তি হন। প্রতিবেশি জ্যাঠার (বাবার বড়ভাই) কাছে থাকেন। জ্যাঠার সঙ্গে মাঠে কাজ করেন। প্রাইভেট পড়িয়ে পড়ালেখার খরচ চালায়। বান্ধবী নাহিদা ইয়াসমিন নুপুরের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন নারী সংগঠনআকাশ শ্রাবণ মহিলা উন্নয়ন সংস্থা।বাবা-মা কাছে না থাকলে সমাজ নানা কুৎসা রটায়। দিপ্তী বিএ পাশ করেন। এনজিও কোডেকে চাকরি পায়। ভালোবেসে বিয়ে করে। সমাজ ভালোবাসার বিয়ে মানতে নারাজ। গর্ভধারণ অবস্থায় দিপ্তী এমএ পাশ করেন। তার স্বামী ভারতে চলে যান। তবু বাংলাদেশ ত্যাগ করেননি তিনি। দিপ্তী বসু কুমিল্লা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি পায়। বাবার দেনা পরিশোধ করেন। ভারত থেকে বাবা-মা ভাইদের বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নিজের নামে ১০ কাঠা বসতভিটা কিনেছেন। তার এক ছেলে। চিতলমারী সদর ইউনিয়নের কুরমনি গ্রামে তার বাড়ি।

সফল জননী

মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় হেমপ্রভা সিংহর (৮১) সংসারে সকল দায়িত্ব নিতে হয়। জায়গা-জমি দেখাশোনা করা, কিষানদের সময়মতো খাবার দেয়া নিজের সন্তানদের যত্ন করা ইত্যাদি একা সামলাতে হিমশিম। স্বামী শচিন্দ্রনাথ সিংহ চিতলমারী এসএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বেতন ছিন মাত্র দুইশটাকা। জলাপূর্ণ জমিতে বছরে একবার ধান হতো। তাতে খরচ যোগাড় করা কষ্টকর। এরই মধ্যে চার ছেলে এক মেয়েকে শিক্ষিত করেন। এমতবস্থায় এলাকাবাসী তার স্বামীকে চরবানিয়ারী ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। তাদের সন্তানেরা এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে মোহিত লাল সিংহ ব্যবসায়ী।

মেজ ছেলে ডা. জওহর লাল সিংহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (সার্জারি) তৃতীয় ছেলে কালাচাঁদ সিংহ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মংলাবন্দর পরিচালক। চতুর্থ ছেলে জোতির্ময় সিংহ হিরণ প্রাক্তন ইউপি সদস্য এবং মেয়ে বাঞ্চা রানী সিংহ এমএ পাশ করে স্বামীর সংসারে। হেমপ্রভা সিংহ চিতলমারী উপজেলার চরবানিয়ারী পশ্চিমপাড়া গ্রামে বাসিন্দা। স্বামী প্রয়াত। ব্যক্তিজীবনের দুঃখ-কষ্ট সয়েও তিনি সন্তানদের শিক্ষিত প্রতিষ্ঠা করেন। 

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরুকারী নারী

বাল্যবিয়ের শিকার রোশ্নী কাজী প্রবঞ্চিত হয়েও থেমে যাননি। তিনি সাত ভাই-বোনের মধ্যে ছোট। তার বিয়ে হয় ২০১১ সালের ০৮ এপ্রিল। স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি-দেবরের যৌথ সংসার। স্বামী তখন বেকার। রোশ্নীর মেয়ে হওয়ার পর নানা নির্যাতন শুরু হয়। বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে মারে। রোশ্নী মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। দেড় মাস পর তার স্বামী রোশ্নীর কাছে যায়। সেখানেই থাকে। ব্যবসা বিদেশ যাওয়ান কথা বলে রোশ্নীর কাছে থেকে কয়েক লাখ টাকা নেয়। স্বামী বিদেশও যায় না, কোনো কাজও করে না। এটা নিয়ে কথা বললে রোশ্নীকে মারে। একদিন স্বামীর ব্যাগে বড় একটা ছুরি দেখে রোশ্নী ভয় পায়। নিরাপত্তার কথা ভেবে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি করে নেয়। বাপের বাড়িতে থাকেন। একটা দুধওয়ালা গরু কেনেন। দুধ বিক্রির টাকায় ছাগল, হাঁস, মুরগির খামার শুরু করেন। এখন মেয়েকে নিয়ে ভালো আছেন। চিতলমারীর হিজলা ইউনিয়নের হিজলা গ্রামের আবুল হাসেম কাজীর মেয়ে তিনি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন।  

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানকারী নারী

দরিদ্র দলিত শ্রেণির সন্তান হয়েও ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনে বিজয়ী হন ঝর্ণা বিশ্বাস। তার বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সে। ছয় ভাইবোনের সংসার কীর্তনগায়েন বাবার পক্ষে চালানো কষ্টকর ছিল। তাই তার বিয়ে হয়। স্বামী দিলীপ বিশ্বা বাঁশ-বেত শিল্প কাঠ মিস্ত্রির কাজ করেন। এলাকার কীর্তন গানের অনুষ্ঠানগুলোতে গিয়ে প্রসাদ বিতরণ জল দান করতেন ঝর্ণা। নিজেদের কোনো জমি নাই। তারপরও প্রতিবেশী কেউ না খেয়ে থাকলে তার বাড়িতে খাবার দেন। এসব বিষয় সবার নজরে পড়ে।  ফলেবাংলাদেশ দলিত প্রান্তিক জনগেষ্ঠীসংগঠনের চিতলমারী উপজেলা সভানেত্রী নির্বাচিত হন ২০১৯ সালে। এলাকায় বাল্যবিয়ে হলে থানা পুলিশ নিয়ে ঠেকান। সরকারি সকল সুযোগ এলাকার মানুষদের পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন। একপর্যায়ে ২০২১ সালে চিতলমারীর হিজলা ইউনিয়নের ,,৯নং ওয়ার্ডে সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি তিন সন্তানের জননী। ইউপি সদস্য হয়ে তার সমাজসেবার ব্যপ্তি বেড়েছে। শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা পেয়ে তিনি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

×