ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

আঁধার পেরিয়ে আলোয় ওয়ান্ডারার্স

জিএম মোস্তফা

প্রকাশিত: ০০:১৬, ১ মে ২০২৪

আঁধার পেরিয়ে আলোয় ওয়ান্ডারার্স

বিসিএল রানার্সআপ হয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে জায়গা করে নেওয়া ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব

ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মিশেলে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব অনন্য। একটা সময় ঢাকার ফুটবলে সাফল্য আর জনপ্রিয়তার বিচারেও শীর্ষে ছিল তারা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আধিপত্য হারিয়ে ফেলে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। তবে দীর্ঘ সময় পর আবারও প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ দিনে কমলাপুর স্টেডিয়ামে তারা গোলশূন্য ড্র করে বাফুফে এলিট একাডেমির সঙ্গে।

আর তাতেই ১৪ ম্যাচে ২৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে খেলার টিকিট নিশ্চিত করে। সেইসঙ্গে প্রায় ২০ বছর পর দেশের শীর্ষ ফুটবলে ফিরে আসার নজির গড়লো ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। ওয়ান্ডারার্সের আগেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে শিরোপা নিশ্চিত করে প্রিমিয়ার লিগে জায়গা করে নেয় ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব। নিজেদের শেষ ম্যাচে পিডব্লিউডি ফুটবল ক্লাবকে হারিয়ে ১৪ ম্যাচ থেকে ২৭ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে থেকে প্রতিযোগিতা শেষ করে তারা।

তবে ফকিরেরপুল এর আগে ২০১৭ সালেও বিসিএল চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রিমিয়ার লিগে উত্তীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু অর্থ সংকটের কথা উল্লেখ করে সেবার দেশের শীর্ষ ফুটবলে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে দলটি।
১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। পঞ্চাশ-ষাটের দশকেই ঢাকার ফুটবলে পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নেয় তারা। সেই সময়ে ওয়ান্ডারার্স-মোহামেডান ম্যাচ মানেই ছিল ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বাড়তি আকর্ষণ। তাদের লড়াই উত্তাপ ছড়াতো গোটা দেশজুড়ে। ১৯৫৩ সালে প্রথমবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে তারা। পরের মৌসুমে টানা দুইবার ঢাকা লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়ান্ডারার্স।

১৯৫৫ সালের লিগেও দলটি এগিয়ে ছিল। কিন্তু বন্যার কারণে সেবার লিগ শেষ হয়নি। পরের বছর ওয়ান্ডারার্সই চ্যাম্পিয়ন হয়। বন্যার কারণে ওই লিগ পরিত্যক্ত না হলে টানা চার লিগ জেতার অবিস্মরণীয় কীর্তিও নজিরও গড়তো ওয়ান্ডারার্স।
কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্লাবটি তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে আর তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। দিনে দিনে চলে যায় আড়ালে। ২০১৯ সালে জুয়ার বড় আসর হিসেবে পরিচিত বহুল আলোচিত ক্যাসিনোকা-ে জড়িত ছিল যে ছয় ক্লাব, তার মধ্যে ছিল ওয়ান্ডারার্সেরও নাম। তবে সেই ঘটনার পরই ওয়ান্ডারার্সের হারানো ভাবমূর্তি ফেরানোর লক্ষ্যে সভাপতির দায়িত্ব নেন কাজী শহিদুল্লাহ লিটন। তার দায়িত্ব নেওয়ার পরই ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে ক্লাবের ভাগ্য।

অনেক চড়াই-উতরাই ফেরিয়ে সম্প্রতি আসে চূড়ান্ত সাফল্য। দীর্ঘ ১৯ বছর পর আবারও প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা। ক্যাসিনো কলঙ্ক এক পাশে রেখে আবারও ফিরে আসে দেশের শীর্ষ ফুটবলে। আর বদলে যাওয়া এই ওয়ান্ডারার্সের নেপথ্য কারিগর কাজী শহিদুল্লাহ লিটন। লিগে ফিরে আসার এমন সাফল্যে তাই অভিভূত ক্লাব সভাপতি। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

গত কয়েক বছর ধরেই ক্লাবের হারানো ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা করে চলেছি। প্রিমিয়ারে ওঠানোর জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু স্পন্সর সমস্যার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কারণে তা হয়ে উঠেনি। তবে এবার আমরা পেরেছি। দীর্ঘ সময় পর এই অর্জনে আমরা সত্যিই আনন্দিত, গর্বিত।’
তবে এই সাফল্যের জন্য সবার আগে খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব দিতে চান শহিদুল্লাহ লিটন। বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতির ভাষ্যমতে, ‘মাঠে খেলোয়াড়দের ভালো পারফর্মেন্সের কারণেই আমরা আজ প্রিমিয়ার লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছি। এটা তাদের পরিশ্রম আর কঠোর অনুশীলণেরই ফসল। তাই আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে সকল খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ জানাই।’

সেইসঙ্গে ক্লাবের কোচিং স্টাফ এবং আমাদের সকল কর্মকর্তাদের প্রতিও আলাদাভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ক্লাব সভাপতি বলেন, ‘ওয়ান্ডারার্সকে শীর্ষ ফুটবলে ফেরাতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন কোচ আবু ইউসুফ। ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান গগন, সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেনসহ প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের জায়গা থেকে সেরাটা ঢেলে দিয়েছেন। সাফল্যের জন্য মরিয়া ছিলেন। তাদের চেষ্টা-সাধনা ছাড়া এই সাফল্য সম্ভব ছিল না। তাই ক্লাবের সকল কর্মকর্তাদের কাছেই আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।’    
ওয়ান্ডারার্সের ফুটবল দলে এক সময় খেলেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ কামালও খেলেছেন ওয়ান্ডারার্সের বাস্কেটবল দলে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজরিত ক্লাবটি পথ হারানোর পর আবারও তার সময়েই দেশের শীর্ষ ফুটবলে ফিরতে পেরেছে। তাই ক্লাব সভাপতি কাজী শহিদুল্লাহ লিটনের গর্বটা আরও বেশি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এই ক্লাবে খেলেছেন। ওয়ান্ডারার্সকে নেতৃত্ব দিয়ে ট্রফি জিতিয়েছেন জাতির জনক। এই ক্লাবের সঙ্গে জড়িত শেখ কামালের নাম।

এমন ক্লাবের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করি। আমার সময়ে এবার হারানো গৌরবও ফিরে পাচ্ছে ক্লাব। এটা আমার জন্য অনেক গর্বের। সেইসঙ্গে নিঃসন্দেহেই এটা  অন্যরকম আনন্দের এক জায়গা।’
১৯৩৭ সালে পুরান ঢাকার কলতাবাজার ও চকবাজারের বাসিন্দারা মিলে গড়ে তুলেছিলেন এই ক্লাবটি। কাজী শহিদুল্লাহ লিটনেরও জন্ম এবং বেড়ে উঠা পুরনো ঢাকার কাজীর দেউরিতে। তাই এই ক্লাবকে নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল সেই শৈশব থেকেই। জয়ের আনন্দে মেতে উঠতে কিংবা সবাই মিলে সাফল্যের জোয়ারে ভাসতে পুরনো ঢাকার মানুষকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার সেই তীব্র আকাক্সক্ষাটা এখনো তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে।

এ প্রসঙ্গটা তুলতেই যেন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ওয়ান্ডারার্সের সভাপতি। তিনি বলেন, ‘সেই শৈশব থেকেই ওয়ান্ডারার্স ক্লাব আমার হৃদয়ে আলাদাভাবে জায়গা করে নেয়। কেননা, খেলাধুলার স্পৃহায় উজ্জীবিত হওয়াটা ছিল পুরনো ঢাকার মানুষের এক অন্যরকম নেশা। যে নেশায় মেতে উঠার আবেগ আমাকে সবসময়ই আপ্লুত করে, উদ্বেলিত করে। সেই জায়গা থেকেই দেশের ফুটবলে পুরনো ঢাকার প্রতিনিধি ওয়ান্ডারার্সকে আবারও সাফল্যের চূড়ায় তোলার স্বপ্ন দেখি।’
সেই লক্ষ্যে পেশাদার লিগে আগামী মৌসুমে ভালো দল গড়ার চেষ্টা করবে ওয়ান্ডারার্স। এমন স্বপ্নের কথাই জানিয়েছেন সভাপতি। কাজী শহিদুল্লাহর ভাষ্যমতে, ‘ওয়ান্ডারার্স যেহেতু পুরনো ক্লাব, ঐতিহ্যবাহী ক্লাব তাই হারানো গৌরব এবং ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনাটাই এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই দেশের ফুটবলে এখন বসুন্ধরার মতো বিগ বাজেটের দল রয়েছে। তাদের মতো অর্থনৈতিক শক্তিশালী ভিত্তি আমাদের নেই। 
কিন্তু আমি এটা নিশ্চিত করতে চাই যে, আমাদের মানসিক শক্তি অনেক প্রবল। ফুটবলে সেই আগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফিরিয়ে আনতে আমরা সর্বোচ্চটাই চেষ্টা করব। যে কোনো প্রতিপক্ষের জন্যই আতংক হয়ে আগামী মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে খেলার চেষ্টা করব আমরা। তবে একটা ক্লাবের শক্তিমত্তা নির্ভর করে তার অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর। তাই দেশের ক্রীড়ামোদি, বিত্তবানদের কাছে ক্লাবের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমার উদাত্ত আহ্বান।’

×