ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

তালপাতার পাখা

বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে তবু কদর কমেনি শৌখিন পরিবারে

মো. খলিলুর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে তবু কদর কমেনি শৌখিন পরিবারে

তালপাতার তৈরি দৃষ্টিনন্দন পাখার কদর রয়েছে এখনো

তালপাতার পাখা এক সময়ের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী এ তালপাতার পাখা। বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য তালপাতার পাখা। গ্রামীণ-বাংলায় তালপাতার পাখার একটা অনন্য ভূমিকা ছিল। এক সময়ে প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হতো ঐতিহ্যবাহী এই পাখা। আধুনিক যুগে তাল পাতার পাখার সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম-বাংলায় ধীরে ধীরে প্লাস্টিকের তৈরি পাখা ও চার্জার পাখা বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে।

তাই কদর কমতে শুরু করেছে তালপাতার পাখার। এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী পাখার স্মৃতি ধরে রাখতেই বিক্রেতারা তালপাতার পাখার সঙ্গে এখন বাঁশের তৈরি নানা রঙের ডিজাইনের দৃষ্টিনন্দন পাখাও বিক্রি করছেন। এ ছাড়াও কাপড়ের পাখাও বিক্রি করছেন অনেক বিক্রেতা। সুতা দিয়ে  বোনা পাখাও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেক বিক্রেতা। আধুনিক যুগে  বৈদ্যুতিক পাখা ও চার্জার ফ্যানের কারণে হাতপাখার ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। তবুও গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলাসহ নানা ধরনের মেলায় হরেক রকমের পাখার পসরা সাজিয়ে বসছেন বিক্রেতারা। বৈশাখ মাস এলেই শুরু হয় তীব্র ভ্যাপসা গরম। 
আর গরমে প্রাণ জুড়ানো শীতল বাতাস পেতে জুড়ি নেই তালপাতার পাখাসহ নিপুণ হাতের তৈরি নানা ধরনের পাখার। গ্রামীণ জনপথে গ্রীষ্মকালে এখনো অপরিহার্য তালপাতার পাখাসহ নানা পাখার ব্যবহার। যদিও আধুনিক যুগে সময়ের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বাড়ছে যন্ত্রের আধিক্য। তারপরেও বিদ্যুৎ না থাকলেই বেড়ে যায় পাখার কদর। এখনো বিভিন্ন হাট-বাজারে, বিভিন্ন মেলায় ও ফেরি করেও গরমের দিনে এক শ্রেণির লোকজন বিক্রি করছেন তাল পাতার পাখাসহ নানা ধরনের পাখা।

তাল পাতার পাখাসহ হাতপাখা নিয়ে নানা ধরনের গানও এখনো শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে। নানা রঙের ডিজাইন ও নক্সার পাখা শোভা পাচ্ছে শৌখিন পরিবারের ঘরেও। অনেক পরিবার ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে কিনে যান হরেক রকমের রঙিন পাখা। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদের ¯œানোৎসবে আসা পুণ্যার্থীসহ নানা পেশার মানুষের কাছে তাল পাতার পাখাসহ নানা ধরনের হাতের তৈরি পাখা বিক্রি করতে ছুটে এসেছেন কয়েক শৌখিন বিক্রেতা। তাদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, তাল পাতার পাখাসহ নিপুণ হাতে তৈরি নানা ধরনের পাখার ঐতিহ্য ও তাদের সুখ-দুঃখের নানা কাহিনী।
তাল পাতার পাখার বিক্রেতা মো. মামুন। বয়স চল্লিশের কোঠায়। তিনি শিশু বয়স থেকেই তাল পাতার পাখাসহ নিপুণ হাতের তৈরি নানা ধরনের পাখা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি শিশু বয়স থেকেই হাটে-বাজারে গিয়ে এক সময়ে তার চাচাত ভাই মো. অহিদ মিয়ার সঙ্গে তাল পাতার পাখাসহ নানা ধরনের পাখা বিক্রি করতেন। এখন তিনি নিজেই বিভিন্ন হাট-বাজারসহ বিভিন্ন মেলায় হাত পাখা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি এখন পনেরো থেকে বিশ বছর ধরে একাই হাত পাখা বিক্রি করছেন। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ইটনা গ্রামে।

তার পিতা হাফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, এখন আধুনিক যুগ। যান্ত্রিক যুগে হাত পাখার কদর কমে গেছে। এখন গ্রামগঞ্জেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে তখন হাত পাখার কদর বাড়ে। কিন্তু যান্ত্রিক যুগে চার্জার ফ্যান এসে হাত পাখার কদর কমিয়ে দিয়েছে। তাই আগের মতো এখন আর হাত পাখা বিক্রি হয় না। তবুও আমাদের আদি পেশাটি এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছি। গরমের দিনে আগে তাল পাতার পাখার কোনো জুড়ি ছিল না। এখন গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে তাল গাছও হারিয়ে যাচ্ছে।

তাই এখন তাল পাতার পাখার সঙ্গে বাঁশ দিয়েও নিপুণ হাতের তৈরি পাখা বিক্রি হচ্ছে। সেই পাখাটি হরেক রকমের রঙে রঙিন করে দৃষ্টিনন্দন করা হয়। এ দৃষ্টিনন্দন পাখা এখন শোভা পাচ্ছে অনেক শৌখিন পরিবারের ঘরেও। তারা দেয়ালে কিংবা ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে নানা রঙের নিপুণ হাতের পাখা সাঁটিয়ে রাখছেন। 
পাখা বিক্রেতা মামুন বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে হাত পাখা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহী করছি। দেশের যে কোনো স্থানে মেলা শুরু হলেই তাল পাতার পাখাসহ নানা ধরনের হাত পাখা নিয়ে ছুটে যাই সেখানে। লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদের ¯œানোৎসবের মেলায় তাল পাতার পাখাসহ বাঁশ ও কাপড় দিয়ে হাতে বানানো পাখা বিক্রি করতে ছুটে এসেছি। একই দিন আমি প্রায় ছয়শ’ হাত পাখা বিক্রি করেছি।

তিনি বলেন, তাল পাতার পাখা ৫০-৬০ টাকা, কাপড়ের তৈরি পাখা ৫০-৬০ টাকা, বাঁশ দিয়ে হাতের তৈরি রঙিন পাখা ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। তিনি এ পাখাগুলো দেশের বিভিন্ন গ্রাম্য এলাকা থেকে কিনে এনে বিভিন্ন মেলায়, হাট-বাজারে ও রাস্তা-ঘাটে বিক্রি করছেন। একই মেলায় আরেক পাখা বিক্রেতা রমজান মিয়া। বয়স পঁয়তাল্লিশের কোঠায়। তিনিও নরসিংদী জেলা থেকে এসেছেন।

তিনিও তাল পাতার পাখাসহ হাতের তৈরি নানা ধরনের পাখা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তার পিতার নাম আসাদুজ্জামান। তিনিও বহু বছর ধরে হাতের তৈরি পাখা বিক্রির পেশায় জড়িত রয়েছেন। তার আপেক্ষ হাতের তৈরি পাখার কদর এখন কমে গেছে। কারণ প্লাাস্টিকের তৈরি পাখা ও চার্জার পাখা বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে আধুনিক যুগে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হচ্ছে চার্জার পাখা। তাই হাতের তৈরি পাখার চাহিদা দিন দিন ম্লান হয়ে আসছে।

একই মেলায় আরেক পাখা বিক্রেতা আলমাছ মিয়া। বয়স চল্লিশের কোঠায়। তিনিও নরসিংদীর ইটনা গ্রাম থেকেই এ মেলায় এসেছেন। তিনি চার-পাঁচ বছর ধরে পাখা বিক্রির পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। নিপুণ হাতের তৈরি পাখাগুলো দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রামগঞ্জ থেকে কিনে এনে বিভিন্ন মেলায়, হাট-বাজারে ও রাস্তা-ঘাটে বিক্রি করছেন। এ বিক্রির আয় দিয়েই চলছে তার পুরো সংসার। তিনি বলেন, হাত পাখা তৈরির পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কারিগররা।

এক সময় নতুন জামাই কিংবা বাড়ির অতিথির জন্য ঘরে রকমারি পাখা বানিয়ে উপহার দেওয়া হতো। যেন বাইরের গরম থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারে। পাখার কারিগররা ডাটি পাখা, হরতন পাখা, ঘুরকি ও পকেট পাখা নিপুণ হাতে তৈরি করছেন। পাখা তৈরি করতে সাধারণত তাল পাতা, সুতা, বাঁশের শলা, বাঁশ ও নানা রং প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরিতে নারীর হাতের ছোঁয়াও লাগছে। নারী কারিগররাও নানা ধরনের পাখা তৈরিতে গ্রীষ্মকালে ব্যস্ত সময় পার করেন। এভাবেই তৈরি হয় নানা ধরনের পাখা।
হাত পাখার ক্রেতা দিলীপ কুমার ম-ল। তিনি কাপড়ের তৈরি রঙিন একটি পাখা একশ’ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ঘরের দেয়ালে সাঁটিয়ে রাখতে। তিনি বলেন, এখন হাত পাখার প্রয়োজন হয় না। কারণে বিদ্যুৎ চলে গেলেও আমাদের ঘরে রয়েছে বেশ কয়েকটি চার্জার পাখা। আরেক পাখার ক্রেতা সুবল বিশ^াস। তিনি বলেন, বাঁশের তৈরি একটি পাখা ৯০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। এক সময়ে হাত পাখার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তাল পাতার পাখার কোনো জুড়ি ছিল না।

কিন্তু এ যুগের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে মানুষের জীবন যাত্রার মানও। হাত পাখার কদর কমলেও এর ঐতিহ্য এখনো বিলীন হয়ে যায়নি। হাত পাখার ব্যবহারের মাত্রা কমেছে। তবে তাল পাতার পাখাসহ নিপুণ হাতের তৈরি বাঁশের পাখা, কাপড় ও সুতার তৈরি হাতের পাতার স্মৃতি মানুষের মনের কুঠিরে জায়গা করে নিয়েছে। এটি একেবারে মুছে ফেলা এতো সহজ নয়। এটি মানুষের মাঝে ঐতিহ্য হিসেবেই  বেঁচে থাকবে চিরকাল।

×