ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নারী আম্পায়ার নিয়ে কেন এই বিতর্ক?

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:১৪, ১ মে ২০২৪

নারী আম্পায়ার নিয়ে কেন এই বিতর্ক?

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নারী আম্পায়ার সাথীরা জাকির জেসি

‘বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’Ñ কবি নজরুলের কবিতার বানী আজ ধ্রুবসত্য। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, কর্মে-সাফল্যে নারীর অর্জন বিশ্বব্যাপী; দেশ পরিচালনায় কিংবা খেলার  মাঠে- সর্বত্র পুরুষের সঙ্গে তারা এগিয়ে চলেছে সমান তালে। বাংলাদেশেও নারীর সাফল্য এখন ঈর্ষণীয়। অনেক ক্ষেত্রে তো ছেলেরা যা পারেনি সেটিও করে দেখিয়েছে তারা। 
সাফ ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব এসেছে মেয়েদের হাত ধরে, এশিয়ান ক্রিকেটের মঞ্চে ইতিহাস গড়েছে টাইগ্রেসরা। গত মাসে চার নারী আম্পায়ার ও এক রেফারি যখন বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির প্যানেলে (ডেভেলপমেন্ট) অন্তর্ভুক্ত হন, দেশের ক্রিকেটে সেটি আসে বাড়তি আনন্দের অনুষঙ্গ হয়ে। অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসতে থাকেন সাথীরা জাকির জেসি, ডলি রানি, চম্পা চাকমারা। এক মাসের ব্যবধানেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন- এই নারীদের মধ্যে অতি পরিচিত মুখ জেসি।

অনভিজ্ঞতার দুয়ো তুলে সুপার সিক্সের ম্যাচে তার অধীনে খেলতে আপত্তি জানালো ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের (ডিপিএল) অন্যতম বড় দুই দল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও প্রাইম ব্যাংক। আয়োজক কমিটি অবশ্য বিষয়টি দৃঢ়তার সঙ্গেই নিয়ন্ত্রণ করে। কিছু সময় দেরিতে শুরু হলেও জেসির আম্পায়ারিংয়ে ভালোভাবেই শেষ হয় ম্যাচ। 
তবে ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ২০২৪ সালে এসে চারদিকে যখন নারী জাগরণ আর নারীর ক্ষমতায়নের জোয়ার ঠিক সেই সময়ে দেশের শীর্ষ দুটি ক্লাবের এমন আচরণ স্বাভাকিভাবে নিতে পারেননি অনেকে। 
এমনকি বিদেশী সংবাদ মাধ্যমেও বিষয়টি উঠে আসে। সর্বশেষ গত রবিবার এ নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হন খোদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) প্রধান ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে অবগত নন। যদিও বিতর্ক তৈরি হওয়ার পর সেদিন মুখোমুখি দুটি ক্লাবের শীর্ষ কর্তাদের পক্ষ থেকে প্রায় একই রকম মন্তব্য এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘নারী বলে নয়, দুই আম্পায়রের অভিজ্ঞতা নিয়েই ছিল তাদের মূল আপত্তি!’ অনাকাক্সিক্ষত এই পরিস্থিতে জেসি যে কষ্ট পেয়েছেন সেটি অনুমেয়, ‘এটা তো স্বাভাবিক খারাপ লাগা কাজ করেই। এতদিন ধরে আম্পায়ারিং করার পরে একটা জায়গায় যাওয়ার পরেই বিসিবি আমাকে এই জায়গায় দায়িত্ব দিছে।

আমি ছেলেদের লিজেন্ড লিগ বা অন্যান্য জায়গায় আম্পায়ারিং করে এসেছি কোনো জায়গায় এ রকম কিছু হয়নি। এই প্রথম এই ধরনের একটা... আমি জানতাম না, আমি শুনিনি পরে নিউজে দেখেছি। নিউজটা দেখার পর খারাপ লাগছিল।’ জনকণ্ঠকে বলছিলেন জেসি। অবশ্য ভারত সিরিজ চলাকালে আইসিসির কোড অব কন্ডাক্টের বিষয়টি মাথায় রেখে এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

বিসিবির পরিচালক ও আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমে মিঠু তাকে সাহস যুগিয়েছেন, ‘না মিঠু ভাই যেটা বলছে যে আমি যেন মন খারাপ না করি। ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ কাল (গত রবিবার) থেকে শুরু। এগুলো নিয়ে মন খারাপ করলে ইফেক্ট পড়তে পারে, মন খারাপ থাকলে তো পিছায় যাব আমি। যেন মন খারাপ না করি, টেনশন না করি। আমার কাজ ছিল ভালো আম্পায়ারিং করা সেটা আমি করে আসছি।’
এর আগে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এ প্রসঙ্গে মিঠু বলছিলেন, ‘তারা (দুই দল) এই বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছিল, কিন্তু পরে মেনে নিয়েছে। তিনি (জেসি) একজন আইসিসির অফিশিয়াল আন্তর্জাতিক আম্পায়ার। তাকে যেহেতু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অবশ্যই মূল্যায়ন করে দেওয়া হয়েছে। এখন এটা না মানলে তো আমরা বৈষম্য করছি।’ মোহামেডানের ক্রিকেট সমন্বয় তরিকুল ইসলাম টিটুর বক্তব্য, ‘আমরা আসলে আপত্তি তুলিনি। আমরা এমনিতে বলাবলি করছিলাম যে ম্যাচের মেরিট অনুযায়ী তো এত বড় ম্যাচে জেসি আম্পায়ার হতে পারে না। 
আমরা বলছিলাম এত বড় ম্যাচে আরও ভালো আম্পায়ার দরকার ছিল। আমরা অফিসিয়ালি অভিযোগ করিনি, অফিসিয়ালি অভিযোগ করব কেন। আমরা ওরকমভাবে রিপোর্ট-টিপোর্ট করিনি।’ প্রাইম ব্যাংক ম্যানেজার শিকদার আবুল কাশেম কঙ্কনের কথায় ইঙ্গিত মেলে তাদের আপত্তি নারী আম্পায়ার হওয়াতেই ছিল, ‘মহিলা আম্পায়ার দেবে এটা তো জানি না আমরা। বাংলাদেশে মহিলা আম্পায়ারের অভিজ্ঞতা কেমন এটা তো আমরা সবাই জানি। আপত্তি করি না।

যেহেতু এটা বড় ম্যাচ, এখানে নিয়মিত যারা করে তাদের আশা করছিলাম। মহিলা আম্পায়ার দেখেন যেটা এলবিডব্লিউ সেটা দেয় নাই, যেটা হয় নাই সেটা দিছে। আমরা ম্যাচ শুরুর আগেও কিছু বলিনি। এমনিতে নিজেরা আলাপ করেছি। সিসিডিএমের কাউকে বলিনি। নিজেরাই আলাপ করেছি। অনভিজ্ঞতার জন্যই।’ 
ক্লাব দুটি যখন অভিজ্ঞতার অভাবকে বড় করে উত্থাপন করছে, তখন ওই ম্যাচের ম্যাচ রেফারি সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসানের সার্টিফিকেট জেসির পক্ষে, ‘একটা ভালো ম্যাচ হয়েছে, চমৎকার আম্পায়ারিং হয়েছে, আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। যে আম্পায়ারকে নিয়ে কথা হচ্ছে তিনি প্রমাণিত, সামনে বিশ্বকাপ করবেন, আজকেও মাঠে আছেন, আইসিসির ডেভেলপমেন্ট আম্পায়ার তিনি, এখন যদি কেউ বলে থাকে নিয়ে কিছু তাহলে সেটা দুঃখজনক।’

আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান মিঠুও আম্পায়ার জেসিকে অনভিজ্ঞ মানতে নারাজ, ‘ম্যাচে কেন একটা অনভিজ্ঞ আম্পায়ার দিয়েছি? জেসি কিন্তু অনভিজ্ঞ আম্পায়ার না। জেসি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণি করে, সর্বশষে ইমার্জিং এশিয়া কাপ, তারপর ভারতে সিনিয়র প্লেয়ারদের যে টুর্নামেন্ট সেসব করে, সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেই কিন্তু আমরা তাকে দিয়েছি।’ সাথীরা জাকির জেসিকে এমন ম্যাচে আম্পায়ারিং দেওয়া নিয়ে অন্য এক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি, ‘আর আমরা এসব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দিচ্ছি, সামনে টি২০ বিশ্বকাপ আছে।

আমরা আমাদের নারী আম্পায়ারদের তৈরি করতে চাই, যাতে বিশ্বকাপে আইসিসি এদেরও কিছু ম্যাচ দেয়। তারাও (আইসিসি) দেখছে, ওরা কোথায়, কী করছে। এখন আমি যদি এদের লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে আম্পায়ারিং না করাই বাংলাদেশে, তাহলে হবে না। সেই ভিত্তিতে আমরা। মেয়ে বলেন, ছেলে বলেন নতুন প্রজন্মে পাইপলাইন তৈরি করার চেষ্টা করছি।’  ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে আম্পায়ার নিয়ে আপত্তি ছিল না বলেও জানান তিনি, ‘মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, তামিম বলেন তাদেরই তো কলিগ (জেসি)।

তারা একই সময়ে খেলা শুরু করেছে। তারা কিন্তু সাধুবাদ জানিয়েছে, ওয়েলকাম করেছে।’ গত বৃহস্পতিবার যে ম্যাচ নিয়ে এত আলোচনা মিরপুরে সেই ম্যাচে জেসির সঙ্গে ফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন এআইএম মনিরুজ্জামান। ম্যাচটি শুরুতে আলোচনায় আসে মুশফিকুর রহিমের আউট ঘিরে। 
বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ হলেও ফিল্ডারের পা লাইন স্পর্শ করায় বিতর্কে ম্যাচ থেমে ছিল কিছু সময়। তবে এক্ষেত্রে মাঠের আম্পায়ারের দিকে আঙ্গুল তোলার সুযোগ ছিল না, সেটা করেওনি প্রাইম ব্যাংক। টিভি রিপ্লে না থাকায় ফিল্ডারের সততার উপরই নির্ভর করতে হয় আম্পায়ারদের। যদিও ম্যাচ শেষে মুশফিক এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছবিসহ একটি পোস্ট দেওয়ায় অনেকে বিতর্কের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেন। রনি তালুকদারের দারুণ সেঞ্চুরিতে ম্যাচে ৩৩ রানের জয় পায় মোহামেডান।

×