ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

পরিযায়ীরা আগের মতো এক স্থানে থাকে না

হাওড় বিলে এখনই আসছে অতিথি পাখি

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ০০:১৬, ৫ নভেম্বর ২০২২

হাওড় বিলে এখনই আসছে অতিথি পাখি

বগুড়ার গোফরার বিলে এবার আগেই এসেছে অতিথি পাখি

গত ক’বছর ধরে পরিযায়ী পাখিরা শীতের আগেই আসতে শুরু করে। একটা সময়ে পরিযায়ী জলচর পাখি নির্দিষ্ট কিছু জলাশয়ে আসত। বেশি আসত সিলেট সুনামগঞ্জ মৌলভীবাজারের হাওড়গুলোতে। বর্তমানে বগুড়ার যমুনার চরে ও বিলগুলোতে অতিথি পাখিরা আসছে। বগুড়ার ধুনটের গোফরার বিলে এই সময়ে সকালে ও বিকেলে অতিথি পাখিদের ওড়াউড়ি চোখে পড়ে। বিলের ধারের গ্রামের মোখলেছুর রহমান বললেন, গত ক’বছর ধরে এই সময়ে অতিথি পাখিরা উড়ে আসে। বিলটি চেনা হয়েছে ওদের। এবারও একই সময়ে এসেছে। এই পাখিদের ওড়াউড়ি দেখলে মন ভরে যায়। বগুড়ার যমুনার চর, ময়ূরীর চরেও অনেক পাখি এখনই এসেছে। চরবাসী বললেন, আগে কম আসত। এখন প্রতিবছর অতিথি পাখির আগমন বাড়ছে। উত্তরবঙ্গের যমুনার চরে বেশি অতিথি পাখি আসছে।
আন্তর্জাতিকভাবে পরিযায়ী জলচর পাখির জন্য বাংলাদেশের ২৮টি স্থান স্বীকৃত ছিল। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য চর মনপুরা, উড়ির চর মুহুরী ড্যাম, নিঝুম দ্বীপ, পতেঙ্গা সৈকত, সোনাদিয়া, মহেশখালী দ্বীপ, আইলার বিল বাইক্কা হাওড়, হাকালুকির হাওড়, টাঙ্গুয়ার হাওড়। গত ক’বছর ধরে এই স্থানের বাইরে আরও অনেক এলাকা যুক্ত হয়েছে। পরিযায়ী পাখিরা এখন আর পূর্বের এক স্থানে থাকে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে উড়ে উড়ে পৌঁছে কিছুটা সময় থেকে ফিরে যায় গন্তব্যে।
পাখিদের নিয়ে রহস্য আজও কাটেনি। ৫ কোটি বছর আগের পাখিদের অভিপ্রয়ান ও পুনরায় আবির্ভাবের রহস্য রয়েই গেছে। সুমেরু ও কুমেরুর প্রাচীন উপজাতিরা মনে করতো পাখি মানুষের আতœা ধারণকারী। বিজ্ঞানীরা আজও রহস্যের সেই জাল ভেদ করতে পারেনি। যা পেরেছে তা শুধুই সাময়িক অভিপ্রয়াণের (মাইগ্রেটরি) বা পরিযায়ী পাখি। দেশে যারা অতিথি।
বরফ আচ্ছাদিত ভূপৃষ্ঠ, যেখানে প্রাণ ধারনের উপকরণ বিলীয়মান, আশ্রমের চরম সংকট সেখান থেকে সাগর মরুভূমি ও বহু পথ পেরিয়ে পাখিরা উড়ে আসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শ্যামল দেশে। যেখানে বন ও জলাশয়ের অবস্থান পাশাপশি। উত্তর গোলার্ধ ও প্লেস্টোসিন সময়ের হিমবাহ পাখিদের বাধ্য করেছিল দক্ষিণে উড়তে। তারপর অভিপ্রয়াণের এই ধারা থেমে থাকেনি। বঙ্গীয় ব-দ্বীপে (বাংলাদেশ) বছরের নির্ধারিত সময়ে এসে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থেকে ফিরে যায়। কিছু থেকেও যায়। পরে এরা দেশের পাখিদের দলভুক্ত হয় পাখিদের সামাজিক অতিথি হয়ে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক খুবই পছন্দ করেছে পরিযায়ী পাখি। ৭২০ একর আয়তনে স্থাপিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস প্রকৃতির গাছগাছালি ও তিনটি বড় জলাশয় (লেক) নিসর্গের বিদ্যায়তন ভূমিতে পরিণত। সত্তর দশকের শেষে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক কয়েক হাজার মাইল পথ উড়ে সেখানে পৌঁছে খুঁজে পায় নিজেদের স্বর্গভূমি। প্রতিবছর ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসতে থাকে লেকে। এই লেক শুধুই পাখিদের অভয়ারণ্য।
সাগর মহাসাগর পাহাড় বনভূমি মরুভূমি অতিক্রম করার সময় পরিযায়ী পাখিদের পথ চিনতে একটুও ভুল হয় না। বিস্ময়কর তাদের দিকদর্শন। গবেষণা করে দেখা গেছে, দেহজ গ্রন্থি, আলোকরশ্নি, বাতাসের গতি, রাতের আকাশের তারকা, ভূমির গন্ধ ও আকৃতির সঙ্গে জিও ম্যাগনেটিজম বিষয়টি পাখিদের জিনগত প্রক্রিয়া। এরা কয়েক হাজার পথ পাড়ি দেওয়ার আগে শরতে অধিক খাবার গ্রহণ করে পালককে শক্তি সঞ্চয় করে রাখে। পাখিরা আকাশে উল্টো তীরের আকৃতিতে ওড়ে। সামনে থাকে গাইড পাখি। যারা এর আগে বাংলাদেশে এসেছিল। তারাই নেতৃত্ব দিয়ে পথ চিনিয়ে আনে। এভাবে প্রতিবছর গাইড পাখি তৈরি হয়। পাখি ভূমিষ্ঠের পর বাচ্চা পাখিকে মা পাখি শিখিয়ে দেয় এক সময় অনেক পথ উড়ে ভিন দেশে যেতে হবে।
অতিথি পাখিদের স্বাগত জানায় বক পাখি। তারপর চখাচখি, সরালি, ল্যাঞ্জা, বালি হাঁস সঙ্গী হয়ে জোটে। এই পাখিরা এক সময় পরিযায়ী ছিল। এখন দেশীয় পাখির আতœীয়। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে নীলশীর ল্যাঞ্জা, পাতারি, পিয়ং গিরিয়া, আবাবিল, কালা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, পান্তামুখী, ক্রেনকুট, এক ধরনের প্যালিক্যান, হেরিয়ার, ফ্যালকন, ওয়ার্বলার, কেস্ট্রোল, ফ্লাই ক্যাচার, ফ্লেমিংগো, ডুবুরি, গাং কবুতর, প্লোভায়, নাইরাল ইত্যাদি। পাশাপাশি আমাদের দেশের পাখির নামের কিছু বিদেশী পাখি আছে। যেমন পানকৌড়ি, রাজহাঁস, মানিকজোড়, খঞ্জনা। দেশে আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি আছে প্রায় ৬শ’। যার আড়াই শ’ প্রজাতি পরিযায়ী। কয়েক প্রজাতি ফিরে যায় না, থেকে যায় এই দেশে।
পাখিদের অভিপ্রয়াণে একই পাখি থাকে কিনা তা প্রথম পরীক্ষা করেন ১৮৯০ সালে ডেনমার্কের পাখি বিজ্ঞানী এইচ সি মটেনসেন। তিনি ল্যাঞ্জা হাঁসের পায়ে ব্যান্ড বেঁধে গতিপথ আবিষ্কারের কাজ শুরু করেন। পরে সফল হন। গত শতকে ভারতের জাতীয় অধ্যাপক ড. সালিম আলী (প্রয়াত) মুম্বাইয়ের বাড়ির আঙিনায় খঞ্জনা পাখির পায়ে রিং পরিয়ে দেন। সেই পাখি বহু বছর তার বাড়িতে আসত। পরিযায়ী পাখির গবেষণায় অংশ নিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অ্যান্ড নেচার (আইইউসিএন), বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, বন বিভাগ, সুইডেনের লিলিয়ান। নভেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশের নদী চর হাওড় বিল ও জাবি ক্যাম্পাসে অতিথি পাখিরা এসে পৌঁছে। এই পাখিরা মে মাস পর্যন্ত থাকে। জিপিএস ট্র্যাক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে শুধু রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল নয় মঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ পশ্চিম চীনের মালভূমি, তিব্বতের একটি অঞ্চল, কোরিয়া, ফিলিপিন্স, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের তীব্র শীত প্রধান অঞ্চল থেকেও পাখি আসছে।
বরেণ্য পাখি বিশারদ জোয়েন পিটার্সের ভাষায় ‘ওয়ানস বার্ডস ওয়্যার গডস টু মেন/ম্যাজিক্যাল স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড ওয়াইজ। নাউ মেন আর ডেভিলস টু দেম অন আর্থ, অন সি, ইন স্কাই।’

 

 

×