ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

খালেদা জিয়া কি আরেকটি দণ্ডনীয় অপরাধ করে ফেললেন

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ১৩ এপ্রিল ২০২১

খালেদা জিয়া কি আরেকটি দণ্ডনীয় অপরাধ করে ফেললেন

ঘটনাটিকে নিয়ে গত শনিবার থেকেই গণমাধ্যমে তুমুল তোলপাড় হচ্ছিল। ঢাকার একটি দৈনিক তাদের অনলাইনে প্রকাশিত খবরে জানায়, দুর্নীতির মামলায় দ-প্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তাও গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কিন্তু সরাসরি বিষয়টি অস্বীকার করে বসে বিএনপি। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপার্সনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক গণমাধ্যমের কাছে সরাসরি দাবি করেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য খালেদা জিয়ার নমুনাই নেয়া হয়নি। এই চিকিৎসক বেসরকারী হাসপাতালের একজন টেকনোলজিস্ট নিয়ে গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসায় গেলে খবর ছড়িয়েছিল যে, তিনি পরীক্ষা করাচ্ছেন। কিন্তু পরে বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রেস উইং থেকেও গণমাধ্যমকে জানানো হয়, করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা দেননি খালেদা। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গিয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। রবিবার নমুনা পরীক্ষার একটি প্রতিবেদন আসে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ‘করোনাভাইরাস পজিটিভ’ লেখা ওই প্রতিবেদনে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করলে তা স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদন দেখায়। যেখানে রোগীর নাম দেখা যায় বেগম খালেদা জিয়া। আইসিডিডিআরবিতে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস পজিটিভ পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। অন্যদিকে রবিবার বিকেলেই আবার এই চিকিৎসক ভদ্রলোক সাংবাদিকদের জানান, ঢাকার গুলশানে খালেদা জিয়া যে বাড়িতে থাকছেন, সেই ‘ফিরোজায়’ তিনিসহ নয়জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, তার অবস্থা স্থিতিশীল। তবে তাঁরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন। একটি বেসরকারী হাসপাতালে কেবিন ঠিক করা আছে। এমনকি বাসায় যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সেটাও একটা হাসপাতালের মতো ব্যবস্থা। একদিনের ব্যবধানের একজন চিকিৎসকের কী আশ্চর্য রকমের ইউটার্ন! কেন এমন হলো? ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন গণমাধ্যমের কাছে। বলেছেন, একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি নাকি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রত্যেকটা রোগীর প্রাইভেসি রক্ষা করা নাকি তার ইমানি দায়িত্ব। ডাক্তারের রুলস নাকি তাই বলে। দেশে-বিদেশে আমাদের পরিচিত চিকিৎসকের অনেকেই নিজেদের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। তাদের কাছ থেকে কখনও এই এথিকসের কথা শুনিনি। বিশেষ করে এ বিষয়ে বাংলাদেশের যখন নিজস্ব একটি আইন আছে। সে কথায় পরে আসছি। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া করোনাভাইরাস পজিটিভ-স্বাস্থ্য অধিদফতর রবিবার সকালে এ কথা জানানোর পরও তা নিয়ে বিএনপি দিনভর নিশ্চুপ ছিল। বিকেলে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে যে, খালেদা জিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এক জরুরী সংবাদ সম্মেলনে এসে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে জানান, ‘খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে তিনি ভাল আছেন, তার অবস্থা স্থিতিশীল। তার কোন টেম্পারেচার নেই, অন্য কোন উপসর্গও তার নেই।’ এর আগে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক যে দাবি করেছিলেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য তার কোন নমুনাই নেয়া হয়নি, এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিএনপি মহাসচিবের কাছে। তার এড়িয়ে যাওয়ার মতো উত্তর হচ্ছে, এই বিষয়ে তিনি বলতে পারবেন না। এটা ওই চিকিৎসকের কাছেই জানতে চাইতে হবে। মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, তার যেটা দায়িত্ব গণমাধ্যমকে জানানোর, সেটা তিনি জানিয়েছেন। এবার খালেদা জিয়ার ঐ ব্যক্তিগত চিকিৎসকের ‘ডাক্তারি রুলস’ প্রসঙ্গে আসি। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, একজন ডাক্তার হিসেবে প্রত্যেক রোগীর প্রাইভেসি রক্ষা করা তার ইমানি দায়িত্ব। ডাক্তারের রুলসে তাই বলে। সকাল থেকে অনেকে ফোন করেছে। কিন্তু পুরোপুরি জিনিসটাকে এবোর্ট করার চেষ্টা করেছি। এখন যেহেতু পজিটিভ ফল এসেছে, তা মহাসচিব বলেছেন। ডাক্তার হিসেবে যেটা তার করার, সেটা তিনি করেছেন। সংক্রামক ব্যাধি আড়াল করা কোন্ ডাক্তারি এথিকসের মধ্যে পড়ে, তা আমাদের জানা নেই। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এই দেশের একজন নাগরিক। রাষ্ট্রের আইন মেনে চলাও কিন্তু তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। গোপনীয়তা রক্ষা চিকিৎসক ও আইনজীবীদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ঠিকই, কিন্তু যদি তাতে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন হয়, তখন কী হবে? আসুন আমরা দেখি দেশের প্রচলিত আইন কী বলে? বাংলাদেশে ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ বলে একটি আইন আছে। এটি হচ্ছে, ২০১৮ সালের ৬১ নং আইন। সেই আইনের কয়েকটি ধারা এখানে উল্লেখ করতে চাই। এই আইনে ‘সংক্রামক রোগের বিস্তার এবং তথ্য গোপনের অপরাধ ও দণ্ড’ উপশিরোনামে বলা আছে, ২৪। (১) যদি কোন ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটিতে সহায়তা করেন বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোন ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তার নিকট গোপন করেন তাহা হলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ। (২) যদি কোন ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন কোন অপরাধ সংঘটন করেন, তা হলে তিনি অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ‘দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান ও নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপনের অপরাধ ও দ-’ উপশিরোনামে বলা আছে, ২৫। (১) যদি কোন ব্যক্তি- (ক) মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তার ওপর অর্পিত কোন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন এবং (খ) সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোন নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ। (২) যদি কোন ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন কোন অপরাধ সংঘটন করেন, তা হলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে, বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ‘মিথ্যা বা ভুলতথ্য প্রদানের অপরাধ ও দণ্ড’ উপশিরোনামে ২৬ (১) ধারায় বলা আছে, যদি কোন ব্যক্তি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য প্রদান করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ। (২) যদি কোন ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন কোন অপরাধ সংঘটন করেন, তা হলে তিনি অনূর্ধ্ব ২ (দুই) মাস কারাদ-ে বা অনূর্ধ্ব ২৫ (পঁচিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ‘ফৌজদারী কার্যবিধির প্রয়োগ’ উপশিরোনামে বলা আছে, ২৭। এই আইনের অধীন সংঘটিত কোন অপরাধের অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও আপীল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানাবলি প্রযোজ্য হবে। ‘অপরাধের অ-আমলযোগ্যতা, জামিনযোগ্যতা ও আপোসযোগ্যতা’ উপশিরোনামে বলা আছে, ২৮। এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য (ঘড়হ-পড়মহরুধনষব), জামিনযোগ্য (ইধরষধনষব) এবং আপোসযোগ্য (ঈড়সঢ়ড়ঁহফধনষব) হবে। আমি আইন বিশেষজ্ঞ বা আইনজ্ঞ নই। কিন্তু বাংলাদেশে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ পাঠ করার পর খুব সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে সাধারণ একটি প্রশ্নÑবিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কি আরেকটি অপরাধ করে ফেললেন? যদি তা হয়, তাহলে তাঁর ওই ব্যক্তিগত চিকিৎসকও কি একই অপরাধে অপরাধী? লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী [email protected]
×