ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

রাজন ভট্টাচার্য

তুমি বন্ধু কেমন বন্ধু...

প্রকাশিত: ২১:০৭, ১৭ জানুয়ারি ২০২১

তুমি বন্ধু কেমন বন্ধু...

ইংরেজ লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ পুরোহিতের কাছে যায়, কেউ কবিতার কাছে, আমি যাই বন্ধুর কাছে।’ আর আইরিশ কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক সি জি লিউইস বলছেন, ‘বন্ধুত্ব হলো দর্শন কিংবা শিল্পকলার মতোই একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়...এর অস্তিত্বগত কোনো মূল্য নেই। এটা বরং এমন বিষয়গুলোর একটা যা অস্তিত্বকে মূল্যবান করে তোলে।’ জগৎ বিখ্যাত মানুষের বন্ধুত্ব নিয়ে রয়েছে নানা উক্তি। বিশ্লেষণ। যা হৃদয়ে স্থান করে রাখার মতোই। বন্ধুত্বকে পবিত্রতার নানা দৃষ্টিকোন থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন তারা। শব্দের শিল্প দিয়ে বন্ধুত্বকে গল্প, কবিতা আর উপন্যাসে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন সবার কাছে। এর মধ্যে দিয়ে বিশ^জুড়ে বন্ধু মানেই একটি ‘পবিত্র’ শব্দ। মহৎ উচ্চারণ। আশ্রয় ও ভালোবাসার জায়গা হয়ে উঠেছে। সময়ের পালাবদলে বন্ধুত্বে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে বন্ধুত্বের রীতিনীতি ও গোটা সংস্কৃতিতে। যা সত্যিই ভাবিয়ে তোলার মতোই। সময়ের গল্প আর কবিতাতেও বন্ধুত্ব এক ভয়ঙ্কর রুদ্র মূর্তি নিয়ে সবার সামনে হাজির হচ্ছে। যা সত্যিই সমাজকে ভাবিয়ে তোলার মতো বিষয়। কিন্তু বন্ধুত্ব তো নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না। সংজ্ঞা দিয়ে বাঁধা যায় না। এর সংজ্ঞা অবারিত। সমুদ্রের চেয়েও বিশাল। হয়তো তার আর প্রয়োজনও নেই...। সময় সংস্কৃতির কিছু কিছু বাস্তবতা এ কথাটিই এখন আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে। যেমন বন্ধুর কাছে গিয়ে জীবন দিতে হলো মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনকে। আনুশকাকে একা পেয়ে বন্ধু আর বন্ধু থাকেনি। বন্ধুত্ব ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। দানব হয়ে উঠেছিল পবিত্র ভালবাসা রূপ। ধর্ষক ভালবাসার পবিত্রতা রক্ষায় হাত বাড়িয়ে দেয়নি। শকুনের চোখ থেকে আগলে রেখে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিতেও পারেনি। উল্টো পরিকল্পিত ধর্ষণের শিকার হয়ে অসময়ে না ফেরার দেশে চলে যেতে হয়েছে বন্ধুকে। ...তুমি বন্ধু কেমন বন্ধু। সবচেয়ে আবেগ আর আশ্রয়ের জায়গাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারনি। নিজ হাতে হত্যা করলে। পারলে? এত ভয়ঙ্কর কাজটি করতে। একবারও হাত কাঁপেনি। ভয় করেনি। হৃদয়ের সবকটি পাজর মড়মড় করে ওঠেনি। না। যদি তাই হতো তবে আনুশকাকে এভাবে প্রেমের বলি হতে হতো না। আবেগের কারণে হয়ত কিশোরীটি প্রাণভরে বন্ধুকে বিশ্বাস করেছিল। জীবনের থেকে বেশি ভালবেসেছিল। স্বপ্ন দেখেছিল তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার। মনের অজান্তেই হয়ত ভবিষ্যত রচনা করেছিল। কিন্তু সেই পাষণ্ড জীবন কেড়ে নিয়ে বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছে কি? এমন ঘটনা সমাজে এখন অহরহ। কোনটি গণমাধ্যমে আসছে। না আসার ঘটনাই হয়ত অনেক বেশি। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুইজন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুইজনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুইজন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগত নাই। দুই জনেই দুইজনের জগত।’ ফরাসি লেখিকা আনাইস নিন বলেছেন, ‘একেক বন্ধু আমাদের মধ্যে একেকটা দুনিয়ার প্রতিফলন, হয়তো সে আসার আগ পর্যন্ত ওই দুনিয়াটাই জন্মায় না। আর কেবল বন্ধুর সঙ্গে মিলনের মধ্য দিয়েই ওই দুনিয়া জন্মাতে পারে।’ ঘটনার প্রেক্ষিতে আলোচনা আর সমালোচনা, মামলা আর সামাজিক প্রতিবাদ যাই হোক না কেন কিশোরীটি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছে বন্ধুত্ব আর আগের মতো নেই। বন্ধু আর নিরাপদ নয়। এখানে বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই। আছে ভোগের লালসা। তাই কথিত ব্যক্তিরা কখনও বন্ধু হতে পারে না। একটা কথা মনে রাখা জরুরী সময়ের কারণে বন্ধুত্বের জায়গাটি বেশ স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ বন্ধুকে বিশ^াস করা কঠিন। বন্ধু নামক পবিত্র ও ভরসার জায়গাটির সকল মান নষ্ট করছে কথিত বন্ধুরা। তাদের থেকে সমাজের সবার আলাদা থাকার বিকল্প নেই। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা বন্ধুত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার, ঘৃণা করার বিকল্প নেই। অর্থাৎ জেনে বুঝে বন্ধু হও। সর্বনাশা বন্ধুর পথ যেন কারও মৃত্যু ডেকে না আনতে পারে। এজন্য পরিবারের পাশাপাশি নিজেদের সজাগ থাকতে হবে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ‘রাজধানীর কলাবাগানের বন্ধুর বাসায় গিয়ে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনের মৃত্যু ধর্ষণের কারণেই হয়েছে। ধর্ষণের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে মামলার একমাত্র আসামি ইফতেখার ফারদিন দিহান বন্ধুদের ডেকে তাদের সহযোগিতায় আনুশকাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’ যুগ এখন আকাশ সংস্কৃতির। হাতে হাতে এনড্রয়েড মোবাইল ফোন। ঘরে ঘরে চলছে হিন্দী সিনেমা, গান আর সিরিয়াল। তারকা হোটেলগুলোতে চলছে বিদেশী সংস্কৃতির গান বাজনা, নাচ। শেকড়ের সংস্কৃতির চর্চা কমেছে। দেশের বড় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বলতে গেলে কোমায় চলে গেছে। সামাজিক সংগঠনগুলোতেও আগের মতো নিজস্ব সংস্কৃতির পরিবেশনা নেই। আবৃত্তি সংগঠনগুলো এখন পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রবেশ করেছে বিদেশী সংস্কৃতি। তাই তরুণ প্রজন্মের মনেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে অপসংস্কৃতির বিকাশ। এরই ধারাবাহিকতায় প্রেমের সংজ্ঞাও বদলে গেছে। বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের প্রভাবে নষ্ট হয়েছে ভালবাসার পবিত্রতা। এখন বন্ধু মানেই আগের মতো বন্ধুত্ব নয়। বন্ধু মানেই...কত কিছু। গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী এ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন, ‘বন্ধু হতে চাওয়া একটা ক্ষণিকের কাজ, কিন্তু এটা এমন ফল যা খুবই ধীরে পাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বন্ধুত্ব আবশ্যিকভাবেই অংশীদারিত্ব।’ তবে এ নিয়ে তার এই উক্তিটিই বোধহয় দুনিয়াজোড়া জনপ্রিয় যে, ‘বন্ধুত্ব হচ্ছে দুই দেহে বাস করা এক আত্মা।’ বইয়ের কথায় ‘বন্ধুত্ব’ এখন আর আত্মাকে হয়ত এক করতে পারে না। দুই আত্মা চলে মতলবে। তাইতো বন্ধুত্ব অভিশাপ হয়ে সামনে আসে। কলঙ্ক ছড়ায়। তবে কি এ নিয়ে কারও দায় নেই। আমরা সবাই বসে বসে দিহানদের অপকর্ম দেখে যাব। মেনে নেব কিশোরীর মৃত্যু। না। এ হয় না। সবার আগে পরিবারের পক্ষ থেকে সন্তানদের দায় দায়িত্ব ও নজরদাড়ি বাড়ানোর বিকল্প নেই। অর্থ ও খ্যাতি আর লাভের আশায় ছুটে গিয়ে মনের অজান্তে অনেক ভুল করছি আমরা। সন্তানদের প্রতি কোন রকম নজরদারি হচ্ছে না। তারা কোথায় যাচ্ছে। কার সঙ্গে গিয়ে মিশছে কোন তদারকি নেই। একক পরিবারগুলো ভাঙতে ভাঙতে আজ মহাবিচ্ছিন্ন। তাই সবার চোখের সামনে আদর, ভালবাসা আর শাসনে সন্তানদের বেড়ে ওঠারও দিন শেষ। তবুও হাল ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। সন্তানদের মানুষ করার দায় পরিবারের যেমন আছে, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজ এ দায় কোন ভাবেই এড়াতে পারে না। আমরা নিজস্ব সংস্কৃতিতে সন্তানদের মানুষ করব, এই চ্যালেঞ্জ থেকে পিছু হটার আর কোন সুযোগ নেই। বন্ধুত্ব অভিশাপ আর ঘৃণা হয়ে সামনে আসুক চাই না। প্রকৃত বন্ধুত্বের শেকড় আরও মজবুত হোক, ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হোক হৃদয়। আলোর পথ দেখাক সব ভালবাসা, বন্ধুত্ব। সমাজে আর কোন দিহান সৃষ্টি হোক তার অনুসারী বাড়ুক চাই না। চাই না বন্ধুত্বের বলি হোক কোন নিষ্পাপ কিশোরী, ভুল পথে চলুক কোন অবুঝ মন। তাকে শোধরে, চোখে চোখে রেখে সঠিক পথে পরিচালিত করাই দায়িত্ব। এই উপলব্ধি সবার মধ্যে জেগে ওঠার সময় এখনই। এখনই। ফরাসি দার্শনিক ও লেখক আলবেয়ার কামুর বলছেন, ‘আমার সামনে সামনে হেঁটো না, আমি হয়তো অনুসরণ করব না। আমার পেছন পেছন হেঁটো না, আমি হয়তো পথ দেখাতে পারব না। আমার পাশে হাঁটো এবং বন্ধু হও।’ লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×