
এই পৃথিবী এক অপার সৌন্দর্যের আঁধার। আঁধার পেরিয়ে আলোর পথে পাড়ি দেওয়ার জন্য এখানে আছে অশেষ পথ ও মত। মতের ভিন্নতায় যেমন মানুষের মৌলিকত্ব, তেমনই জীবনকে উপভোগ আর চেখে দেখার প্রাতিস্বিকতায় মানুষের ব্যক্তিতা তৈরি হয় আলাদা আলাদা কল্পনা ও চিন্তার উঠোনে। বাঁধা-পড়ার আর বাঁধন ছেঁড়ার খেলায় আমরা যে মত্ত, তার শক্তি ও সৌন্দর্য ধরা পড়ে সৃজনশীলতা আর প্রকাশের ভারের ভেতর। প্রোফেট, পোয়েটরা মানুষের জীবনের অর্থ ও অনর্থের মধ্যে একটা চমৎকার সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। বর্তমানে নবী না থাকলেও কবিরা ভাবনার ও পরিকল্পনার চরকা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকৃতি আর মানুষের, মানুষের আর স্রষ্টার সম্বন্ধ বিষয়ে চিন্তার ধারাভাষ্য বিবরণে। কবিরা ‘ওহি’ পান কোথাও-না-কোথাও থেকে। নবী নন তারা কিন্তু যে-বারতা তারা দিয়ে যান, তাতে মানবতা আর শান্তির আহ্বান ছাড়া বিনাশের কোনো ইঙ্গিত আজ অবধি মেলেনি। খুব ছোট্ট করে যদি বলি, তাহলে কবিরা এক ধরনের আচ্ছন্নতা থেকে যাপন করেন শব্দের ধ্বনিকাল। এ থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় নেই। জোর করে কিংবা ক্লাসে পড়ে অথবা ‘তরুণ লেখক প্রকল্প’ যে কবি তৈরি করতে পারে না, তা প্রমাণিত। সাধনা করে গবেষক হওয়া চলে- কবি নয়। মাইকেল মধুসূদন বলেছিলেন- ‘আশার ছলনে ভুলি’ আর কবি আসাদ চৌধুরী জানিয়েছেন- ‘চোখের দোষে কাতর’ তিনি, যে-কাতরতা তাকে কবি বানিয়েছে। প্রথমে সৌন্দর্য ও রহস্য- এই পৃথিবীর অসীম অব্যাখ্যায় অধ্যায়সমূহ দেখে কবিরা বিমুগ্ধ হন। তারপর তাঁরা সাজাতে থাকেন শব্দের মালা; চালাতে থাকেন কল্পনার শাবল ও হাতুরি। এভাবে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ব্যক্তি, তার এক বিশেষ কাঠামোকে আমরা নাম দিয়েছে কবিতা। ক্ষমতা এবং আধিপত্যই যখন সমাজ এবং রাষ্ট্রনীতির ভেতর-কথা, তখন কবিতার শক্তিও বিবেচ্য হয়ে পড়ে অন্তত কবিতা-কারিগর আর ভোক্তাগোষ্ঠীর কাছে। শক্তি আর সামর্থ্যকে যদি আলাদা করে ভাবতে আমাদের কোনো কৌশলগত অসুবিধা না থাকে, তাহলে দেখতে পাবো কবিতার পরিপ্রেক্ষিত একেবারে সামান্য নয়; ভাবনা-পরিসর প্রসারণে আর মানব-মাহাত্ম্যকে ধারণ করতে কবিতার রয়েছে এক ঐতিহ্যিক অবস্থান।
অন্নদা শঙ্কর রায়ের একটি কবিতা দিয়ে শুরু করা যাক- ‘যতোকাল রবে পদ্মা-মেঘনা/ গৌরী-যমুনা-বহমান/ ততোকাল র’বে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।’ হ্যাঁ, যদিও বর্তমানে মানুষের চিন্তায় কর্মে ‘রক্তগঙ্গা’, ‘অশ্রুগঙ্গা’ বয়ে চলেছে নিরন্তর, তবু কেমন যেন অন্তরে অন্তরে প্রবাহিত প্রশান্তির বাতাস। আর সে-বাতাস শুধু স্বাধীনতার কারণে। এই স্বাধীনতা যার হাত ধরে বাঙালীর ঘরে, মনে ও চিন্তায় প্রবেশ করেছে, তিনি বঙ্গবন্ধু। জয়ের যে মালা বাঙালীর গলায় পড়িয়ে দিয়েছেন শেখ মুজিব, তার কোনো ক্ষয় নেই। আর তাই, তাঁকে নিয়ে বন্ধনারও কোনো শেষ নেই। বাঙালী কবিরা বঙ্গবন্ধুর বন্দনায় প্রধানত শ্রদ্ধাশীল এবং শেষত আন্তরিক। ১৯৭১ সালে কবি জসীমউদ্দীন ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতায় লিখেছেন- ‘মুজিবর রহমান/ ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।’ নির্মণেন্দু গুণ সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর মধ্যে, তাঁর কথা ও কল্পনার ভেতর কবিত্ব-শক্তি আবিষ্কার করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণকে তিনি একটি অনবদ্য কবিতা বলে কল্পনা করেছেন। ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় তিনি বলেছেন-
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি
‘একান্ত মানচিত্র বাংলার’ কবিতায় হাসান হাফিজুর রহমান বলতে চেয়েছেন কোনো কোনো জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে, ঐতিহ্যের ডানা বেয়ে কোনো একা মানুষ হয়ে ওঠেন অতুলনীয় মহামূল্যবান পতাকার সমান। কোটি কোটি দুঃখক্লান্ত রাত পারি দিয়ে মানুষ কোনো এক সময় হয়তো স্বপ্নের ভুবনে পৌঁছে যায় সেই অনন্য পতাকাসম মানুষটিকে আশ্রয় করে। বাংলাদেশে ‘মহার্ঘ্য প্রতীক‘ মানুষটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ‘যে আজ/ সমস্ত শরীর মেলে দিয়ে একান্ত মানচিত্র বাংলার,/ আপামর বাংলার।‘ দেশের প্রতিটি নাগরিকের মনের দরোজায় যে-লাল-সবুজের পতাকা আর শোভিত তা, তার রক্তের রঙে আঁকা যেন। কবির অনুভব- ‘মহামূল নীলকান্তমণি নয় সে/ যে প্রতিটি স্বতন্ত্র অনামিকা শোভিত করবে/ আকাশি জৌলুসে।/ বরং সে ঠিক সূর্যের মতোই একা।/ প্রত্যেকেরই চোখের সামনে খোলা। সবাইকে ছুঁয়ে আছে,/ আমরা পারিনি ছুঁতে। প্রতিটি ব্যক্তিগত দিগন্তের মতো,/ নিষ্ঠুর দূরায়ত অথচ কত কাছাকাছি।’
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বাঙালী জীবনে এক কালো অধ্যায়। তাঁর কোনো রিপ্লেসমেন্ট নেই। সেই অভাব-অনুভব-করা এক কবি সুফিয়া কামাল ‘ডাকিছে তোমায়’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুর জন্যে মানুষের মনে জমে-থাকা অসীম হাহাকার ও প্রত্যাশার কথা বলেছেন। সস্তা সমাজ-ব্যবস্থায় দামী মানুষের অভাব যে খুব টের পাওয়া যায়, তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। নতুন বাংলাদেশে, অচেনা বাংলাদেশে তাঁর মুক্তির বাণীই যে প্রধান শক্তি ও প্রেরণা, তা কবি ভোলেননি। ভোলেনি বঙ্গবন্ধুর বাংলার অগণিত মানুষ। কবি লিখছেন সে-কথা-
এই বাংলার আকাশ, বাতাস, সাগর গিরি ও নদী
ডাকিছে, তোমারে বঙ্গবন্ধু! ফিরিয়া আসিতে যদি।
হেরিতে, এখনও মানব হৃদয়ে, তোমার আসন পাতা
এখনও মানুষ, স্মরিছে, তোমারে, মাতা, পিতা, বোন ভ্রাতা।
যত অসহায়, অক্ষম আর উপক্ষেতরা সব,
করুণ নয়নে, হেরিছে, এ দেশে, বিলাসের উৎসব।
স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লিখেছেন ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যের অমর সব কবিতা। বিশেষ করে তাঁর ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ কবিতা দুটি বাঙালীর চেতনার জন্য দারুণ প্রেরণা বহনকারী রচনা। আশির দশকে স্বৈরশাসনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে লেখেন ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতা। এই কবিতায় তিনি শেখ মুজিবের পৌরুষ, তাঁর অতুলনীয়তা এবং তাঁর জন্য মানুষের হাহাকারের কথা তুলে ধরেছেন। খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারে-
দেখ, প্রত্যেকটি মানুষের মাথা
তোমার হাঁটুর চেয়ে এক তিল উঁচুতে উঠতে পারছে না কিছুতেই।
তোমাকে হারিয়ে
আমরা সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো
ঘয়ে যাচ্ছিলাম,
আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিলো শোকের পোশাকে,
তোমার বিচ্ছেদের সঙ্কটের দিনে
আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে ব’সে বিলাপে ক্রন্দনে আকাশকে ব্যথিত
করে তুলেছিলাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে
রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে, কেননা জেনেছি
জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।
১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের জন্য এক অন্ধকার অধ্যায়ের নাম। ওই ভয়াল রাতে বাংলাদেশের ভাগ্যকে টেনে নিচে নামিয়ে এনেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো কেউ সত্যকে ঢেকে রাখতে পারেনি। সত্য তার সৌন্দর্য নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে যথাসময়ে। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘পনেরো আগস্ট’ কবিতায় তেমনই এক সত্যের বারতা বহন করেছেন। লিখেছেন মৃত্যুর পরও কীভাবে বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন বাঙালীর জীবনে-
মানুষ তো ভয় পায় বাক্হীন মৃত্যুকেই
তাই ওঠে নড়ে
থেকে থেকে গাছের সবুজ পাতার ভেতরে।...
জন্মনাভি! বোঁটা থেকে দ্যাখো আজও
অভিভূত রক্ত যায় ঝরে
বাঙালির কলমের নিবের ভেতরে।
স্তব্ধ নয় ইতিহাস! বাংলায়ও সুদূরগামী
তোরোশত নদীর ওপরে ওই আজও তো নৌকোয়
রক্তমাখা জনকের উত্থান বিস্ময়!
১৫ আগস্টে ৩২ নম্বরে যারা হামলা করেছে, তারা কি পরিচিত ছিল? তাদেরকে কি ওই বাড়ির লোকেরা কিংবা কর্তা ব্যক্তি খুব বিশ্বাস করতো? তারা কি ভাবতে পেরেছিল যে, ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে? ওরা কি সত্যি সত্যি শত্রু ছিল? না-কি ভাড়া করা লোক ছিল? ভাড়ায় এলে কত টাকা পেয়েছিল? টাকা দিলে কি ওরা নিজের পরিবারের লোকদেরকে এভাবে মারতে পারতো? ওরা কি তখন স্বাভাবিক ছিল?না-কি মাতাল ছিল? ওরা কি কারো কিংবা কারো কারো নির্দেশ পালন করতে এসেছিল? হত্যা করে তারা কি সুখ পেয়েছিল? না-কি তারাও কেঁদেছিল গোপনে? কিংবা হত্যাকারীদের কেউ কি ৩২ নম্বরের কারো প্রেমে পড়েছিল? প্রেমে কি ব্যর্থ কিংবা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল? কেন তারা হত্যা করলো? ৩২ নম্বরের লোকেরা দেশের কী ক্ষতি করেছিল? সত্যিই কি তারা কিংবা তাদের কেউ একজন তাদের জন্য- সকলের জন্য ভয়ঙ্কর ছিল?- এমন গোছালো কিংবা অগোছালো ভাবনা আমাদেরকে আচ্ছন্ন করতে পারে। কবিকেও। শহীদ কাদরীর ‘হন্তারকের প্রতি’ কবিতা-ভাবনা থেকে পাঠ নেওয়া যেতে পারে-
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোন উপমায় তাদের গ্রেফতার করা যাবে না।
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম,
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিল,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালীর মতো
বাংলাভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলার মানুষ
এর চেয়ে ভয়ানক কোন কথা আমি আর শুনবোনা কোনদিন।
বাংলাদেশের এক নান্দনিক কবির নাম রফিক আজাদ। ষাটের দশকের এই কবি স্বাধীনতা-উত্তরকালে সমকালের কণ্ঠস্বর হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বর্তমান তাঁর কবিতার বিষয়-আশয়। তিনি মনে করেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে সিঁড়ি বেয়ে রক্তধারা চলে গেছে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত। তিনি বিশ^াস করেন বঙ্গবন্ধু প্রকৃতি ও সবুজের অকৃত্রিম সন্তান। তাঁর ধারণা বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে বিশাল মানুষ বঙ্গবন্ধু। ‘এই সিঁড়ি’ কবিতার কিছু-অংশ এরকম-
স্বপ্ন তার বুক ছিল ভ’রে,
পিতার হৃদয় ছিল, স্নেহে-আর্দ্র চোখ-
এদেশের যা কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র
তার চোখে মূল্যবান ছিল-
নিজের জীবনই শুধু তার কাছে খুব তুচ্ছ ছিল:
স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে প’ড়ে আছে
বিশাল শরীর...
তার রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে,
সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ :
তার ছায়া দীর্ঘ হতে হতে
মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে!
১৯৪৭ ছিল বাঙালীর ভাগ্যবদলের এক মাইলফলক। তারপর ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯। তারপর ‘একাত্তরে কলস উপুড়’। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী এভাবেই ভাবেন বাংলার ইতিহাস। আর নির্ধারণ করেন আমাদের মানচিত্রের দলিল-দস্তাবেজ। লিখেছেন তিনি ‘রক্তের গম্বুজ’ কবিতায়-
তর্জনী তুলতেই
আকাশ আমাদের হ’য়ে গেলো
পা ফেলতেই
চৌহদ্দি নির্দিষ্ট হ’য়ে গেলো
এবং তাকাতেই
প্রবাহিত হ’তে থাকলো নদী
তাঁর কণ্ঠস্বরে সূর্য ও সবুজ এক হ’লো :
‘আমার সোনার বাংলা...’
স্বপ্ন ডাক দিয়েছিলো টুঙ্গিপাড়ায়।...
বত্রিশ নম্বর এখন রক্তের গম্বুজ
তার চূড়ায় মূল দলিল, নকশা আর পর্চা...
মানুষ কখনো সামনে এগোয় কখনো পিছিয়ে পড়ে। কখনো নিজেকে রাখে স্থির। প্রতিবেশকে ধারণ করে ব্যক্তি। ‘লোকটি কেন পিছিয়ে গেলে’ কবিতায় হাবীবুল্লাহ সিরাজী লিখছেন-
লোকটি কেন পিছিয়ে গেলো?
ছিলো বেশ, বাড়া ভাতে ছাই না পড়লেও
কয়লায় খটখটে তাপ না হ’লেও
উচ্চিংড়ে ও লেংটাপুটো ফরমায়েশে ভাঁপছিলো,
ছ্যাঁত লাগে কী লাগে না লোমের গোড়া কাঁপছিলো,
মাটি-গোবরে গাঁদা এবং দোপাটি বামে-ডানে দুলছিলো;
মাছের আঁশ, চাঁদের খোসা, নুনের গতর হাওয়া বুঝে খেলছিলো
ছিলো তো ছিলো বেশ ছিলো; তবু কেন পিছিয়ে গেলো?
তাহলে উপায় কী? পিছিয়ে পড়বো আমরা? কবিতার কি কোনো দায় নেই? হ্যাঁ, কবিতা হয়তো কখনো কখনো বিপন্ন মানুষকে সামনে এগোতে সাহায্য করে। কখনো-বা বয়ে নিয়ে আসে নতুন নতুন পাঠ ও প্রতিজ্ঞা। মোহাম্মদ সাদিকের একটি কবিতা থেকে পাঠ নিচ্ছি-
নেমেছে গভীর অন্ধকার
ভবতরী নিয়ে আমি শেরে বাংলা নগরে
আটকে আছি গুরু তুমি উপায় বলো না!
মানুষেরা সত্য শব্দ ভুলে গেছে এবং এখন মিথ্যাই প্রধান
এমন সময় আজ, কেউ কারও কথাই শুনছে না!...
গুরু উপায় বলো না
আমি কী করে নদীকে বলব, নদী তুমি মরুভূমি পুনরায় জলবতী হবে
সেখানে একটি বোয়াল মাছের লেজে রুপালি ঝিলিক হবে
তোমার বুকেও পূর্ণিমার আলো হবে...
কীভাবে এমন অন্ধকার, গাঢ় রাত, এই ভবতরী
পার করতাম!
আমার মাথায় বারি গুরু আমি দম হারাইলাম!
(‘গুরু উপায় বলো না’)
মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। জগতের বড় বড় পরিবর্তন ঘটেছে ওই চিন্তায় ভর করে। কখনো কখনো দুশ্চিন্তা নামক মহামারী মানুষকে ক্লান্ত করলেও চিন্তাই ইতিবাচকতার হাটে পৌঁছে দিয়েছে মানুষের আবাদের সকল ফসল ও কারবার। প্রশস্ত প্রান্তওে, উঠানে, বারান্দায়, ঘরের বিরাট মেঝেতে পাঁয়চারি করতে করতে কিংবা কখনো হুঁকায় কিংবা বিড়ির টানে কখনো-বা পাইপ ঠোঁটে চেপে মানুষ পারি দিয়েছে চিন্তার সমুদ্র। কবি মোহাম্মদ সাদিক ‘বঙ্গবন্ধুর পাইপ’ কবিতায় নির্মাণ করেছেন সেই চিন্তাস্তম্ভ, যেখানে সাজিয়ে তুলেছেন অপার কথামালা, যাতে লেখা আছে- কীভাবে বঙ্গবন্ধুর পাইপে ভর করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নেরা খেলা করেছে। তিনি মনে করছেন, ওই পাইপে ঠোঁট রেখে শেখ মুজিব মনোযোগ স্থাপন বাংলার মুক্ত-স্বাধীন আকাশের দিকে-
ষাট দশকে যখন দারুণ ঝড় বইছিল
বাংলায়, তখনো সেই পাইপটি জ¦লছিল তার হাতে।
সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরে পাকিস্তানের কারাগারে
নির্জন অন্ধকারে সেই পাইপ কখনো নেভেনি।
এই বাংলার ভবিষ্যৎ, বাংলার স্বাধীনতার বিষয়টি তখন
নির্ধারিত হয়েছে এই পাইপ টেনে টেনে।
বঙ্গবন্ধুর নিত্যসঙ্গী পাইপটি দিনে দিনে তাঁর ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে। তাঁর স্বাতন্ত্র্যের অনন্য ধারক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু, পাইপটির অটলতা ভেঙে পড়ে জাতির পিতার মর্মান্তিক হত্যার মধ্য দিয়ে। কবি জানাচ্ছেন সে-কথা- ‘শুধু পঁচাত্তরে পনেরোই আগস্টে/ টকটকে লাল রক্তের ছিটায়, ঘন অন্ধকারে/ প্রিয় পাইপটি অকস্মাৎ কাত হয়ে পড়ে, আর/ বাংলার সমূহ স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিঃশেষ হতে দেখে/ ক্ষোভে দুঃখে অপমানে ও ঘৃণায়/ বাংলাদেশের প্রিয় পাইপটি নিঃশব্দে নিভে যায়।‘ অতঃপর বাংলাদেশের ঠিকানা থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় একটি পাইপ- অভূতপূর্ব পাইপ!
ধরা যাক, একজন ফটোগ্রাফার তাঁর ক্যামেরার ফ্রেমে আঁটছেন সমকালের সুখ ও যন্ত্রণা। তিনি শিল্পী। ফটোগ্রাফার যে ছবিটি আজ তাঁর ক্যামেরায় বন্দী করলেন, তা স্থিরচিত্রে ধরা না পড়লে কী হতো? ছবিটি কী স্থিরচিত্রশিল্পী দেখেননি? দেখেছেন। তাহলে ওটাকে ফ্রেমবন্দী করা কেন? আরো কিছুকাল চোখের সামনে তাকে জীবন্ত করে রাখার জন্য? নাকি অন্যের কাছে তা প্রকাশ করার জন্য? আর অন্যের কাছে প্রকাশের পিছনে কি নিজেকে জাহির করা বা হাজির রাখার কোনো ইচ্ছা লুকিয়ে
আছে?- এসব জিজ্ঞাসা থেকে শিল্পের কারবার আর শিল্পীর দায় ও দায়িত্বের কিছু প্রসঙ্গ আমাদের চেতনাকে হয়তো কখনো নাড়া দিয়ে যায়। রুমালে যে নারী সুতো লেপে তৈরি করেন প্রিয়জনের প্রতি নিমগ্নতা, তাকে কি বিরত রাখা চলে? অথবা তার বুননে যে কথা লেখা আছে তার সবটা কি ধরা পড়ে ওই প্রিয়পুরুষের চোখে? শিল্পের ওই একটা সীমাবদ্ধতা! শিল্প কিংবা শিল্পী যা বলে, তার খানিকটা প্রকাশ পায়, অধরা থেকে যায় অনেকটা। এবং কল্পনাবিলাস ও অনুভবের কিংবা সত্যবিবরণের ওই বেশিরভাগটা চিরকালই প্রকাশের আড়ালে থেকে যায়। শিল্পের বেদনা আর শিল্পীর ব্যর্থতা যদি কিছু থেকে থাকে, তো সেটা এই অপ্রকাশের ভার। আর সর্বদাই প্রকাশের দায় ও ভারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে শিল্প ও শিল্পীর সাফল্য। কবিতাই হোক, হোক কথাশিল্প কিংবা চিত্রশিল্প অথবা সঙ্গীত, চিত্রকলা ও নাট্যকলা- সবক্ষেত্রেই শিল্পবোধের প্রতি লেখক-নির্মাতা-আঁকিয়ে-নির্দেশক-প্রযোজকের ব্যক্তিক ও সামাজিক দায় এবং চিন্তা প্রকাশের মনোগত ভার সবকিছুকে পেছনে ফেলে আপন মহিমা ও তাৎপর্যের বিচারে বিবেচনার সামনের কাতারে জায়গা করে নেয়। আর তাই, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত কবিতায়ও আমরা পেয়ে যাই শিল্পীর কোনো-কোনো না-বলা কথার অন্তর্বেদনার আনন্দময় প্রকাশ।