
বাউলা কে বানাইলো রে
হাছন রাজারে বাউলা, কে বানাইলো রে
বানাইলো বানাইলো বাউলা, তার নাম হয় যে মাওলা
দেখিয়া তার রূপের ঝলক, হাছন রাজা হইলো আউলা
-দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী
আধ্যাত্মিক চেতনার মরমি কবি ও বাউল শিল্পী দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। যদিও জানা যায় তাঁর প্রকৃত নাম অহিদুর রেজা, তবে তিনি মানুষের কাছে ‘হাছন রাজা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। বাংলার মরমি ও লোকসঙ্গীত বিশ্বদরবারে সমাদৃত হওয়ার পেছনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন হাছন রাজা। তিনি তাঁর জীবনের প্রথম দিকে ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী নিষ্ঠুর জমিদার। উচ্চবিলাসী জীবনযাপন, আমোদ-প্রমোদ এবং প্রজাদের উপর নির্মম অত্যাচার করাই ছিল যাঁর কাজ। সেই তিনিই আবার বিশাল জমিদারি ত্যাগ করে গ্রহণ করেন অতি সাধারণ জীবন। আভিজাত্যের চাকচিক্য ভুলে সাদাসিধে বৈরাগ্য জীবনে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। স্রষ্টার সন্ধানে নির্জন সাধনায় আত্মনিয়োগ করে জগত সংসার নিয়ে উদাসীন হয়ে যান। একের পর এক আধ্যাত্মিক গান রচনা করতে থাকেন, যার সংখ্যাটা প্রায় সহস্রাধিক। তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, যা অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিশেষভাবে আকর্ষিত করেছিল। বিশেষ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূনসহ আরও অনেকেই উনার জীবন দর্শনের প্রভাবিত হয়েছিলেন। এমনকি ইংল্যান্ডের রাজ দরবারেও এই মরমি সাধকদের বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্পটা পৌঁছে যায়। ১৯৩৩ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’র উদ্যোগে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাদেশের মরমি কবিদের মধ্যে চারজনকে দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই চারজন হলেনÑ লালন শাহ, শেখ ভানু শাহ, শেখ মদন শাহ ও হাছন রাজা। যদিও বাস্তবে তিনি আধ্যাত্মিক আরাধনা কিংবা আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রদর্শন করার কথা শোনা যায়নি। তবে লোকমুখে প্রচলিত ছিল, হাছন রাজা অল্প বিস্তর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। অনেকেই তাঁকে আল্লাহর অলি হিসেবেও দাবি করেন। তবে তিনি সূফি মরমি সাধক, বাউল কবি, দার্শনিক কবি হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও সমাদৃত। হাছন রাজার রচনাবলির সাহিত্য মূল্যায়নে দেখা যায়, তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী লোকসাহিত্যের একজন অন্যতম বাউল কবি ছিলেন। তাঁর গানগুলোকে আধ্যাত্মিক গান, মারফতি গান, মুরশিদি গান, মরমি গান, দেহতত্ত্ব গান, পল্লী গান, লোকসঙ্গীত প্রভৃতিতে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী সুনামগঞ্জ জেলার লক্ষণশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামে ১৮৫৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নাম দেওয়ান আলী রাজা এবং মাতার নাম মোছাম্মৎ হুরমৎজান বিবি। পৈত্রিক বাড়ি রামপাশা, বিশ্বনাথ সিলেটে এবং মায়ের বাড়ি খালিয়াজুড়ি, নেত্রকোনা বৃহত্তর ময়মনসিংহে। হাছন রাজার পিতা দেওয়ান আলী রাজা ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। তাঁর পূর্বপুরুষের অধিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায়। বংশ পরম্পরায় তাঁরা হিন্দু ছিলেন। তারা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা হয়ে সিলেটে আসেন। তাঁর দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, হাছন রাজার অনেক কবিতা ও গানে পূর্বপুরুষের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার মিলবন্ধন পাওয়া যায়। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি, তবে তিনি ছিলেন সুশিক্ষিত। হাছন রাজার দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনার স্বীকার হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাছন রাজা জমিদারিতে অভিষিক্ত হন। হাছন রাজা কিশোর বয়স থেকেই পিতার জমিদারির ভোগ বিলাসে মত্ত ছিলেন। যখন অল্প বয়সে বিশাল জমিদারি পেয়ে গেলেন, তিনি যেন তখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তখন ব্যাপকভাবে তাঁর চারিত্রিক স্থলন ঘটে এবং ভাল মন্দের বিচার না করে নিজের মর্জি মাফিক চলতে থাকেন। কথিত আছে, হাছন রাজার বিলাসবহুল নৌ-তরী ও কয়েকটি রঙমহল ছিল। যেখানে তিনি মদ্যপান, বাঈজি নাচসহ বিভিন্ন ধরনের আমোদ-প্রমোদ করতেন। এছাড়াও ওই রঙমহলগুলোতে জোরপূর্বক অসংখ্য রমণীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হন। তাঁর জমিদারি এলাকায় কোন রমণী নিরাপদ ছিল না। যাকে ভাল লেগেছে, জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যেতেন তার রঙমহলে। অবশ্য তাঁর চরিত্রের এই বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর উত্তরসূরিরা দ্বিমত পোষণ করেন। যদিও হাছন রাজার বেশ কিছু গানেই কথিত কথাগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়। যেমন তিনি একটি গানে বলেছেন, ‘সর্ব লোকে বলে হাছন রাজা লম্পটিয়া’ এছাড়াও তিনি প্রজাদের উপর নির্মমভাবে জোর জুলুম করতেন। হাছন রাজা তখন অত্যাচারী জমিদার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন এবং গান বাজনা নিয়ে মজে থাকতেন। তাঁর নিজে গানের দলও ছিল, যাদের নিয়ে তিনি নিজেই গান বেঁধে গান গাইতেন। হাছন রাজার যৌবনকালের উল্লেখযোগ্য কিছু গান হচ্ছে- ‘সোনা বন্দে আমারে দেওয়ানা বানাইল’, ‘নেশা লাগিল রে’ প্রভৃতি। কথায় কথায় ছন্দ কেটে কথা বলাও তাঁর অভ্যাসে ছিল। এভাবেই তাঁর মাঝে কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
ভোগ বিলাসী অত্যাচারী জমিদার হাছন রাজার এক সময় আমূল পরিবর্তন আসে। তাঁর মধ্যে ধীরে ধীরে এক আধ্যাত্মিক বোধের জন্ম নিতে থাকে। যা তাঁর স্বপ্ন ও জীবন দর্শনে আমূল প্রভাব ফেলে। বেপরোয়া জমিদার থেকে তাঁর চরিত্রে এক শান্ত ভাব চলে আসে। বিলাসী জীবন ছেড়ে তিনি সাদামাটা জীবন বেছে নেন। জমকালো পোশাক ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক পরতে শুরু করেন। তার বহির্জগত ও অন্তর্জগতে আসে বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তার এক ধরনের অনীহা, এক ধরনের বৈরাগ্য তৈরি হয়। একপর্যায়ে তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নামরে, না করলাম তার কাম।’ বৈরাগ্যভাব আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাছন রাজা সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। অত্যাচারী নিষ্ঠুর শাসক থেকে হয়ে গেলেন সাধক। একসময় তিনি গেয়ে উঠেছিলেন- ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন।’ এর মধ্যেই আছে আত্মোপলব্ধির এক মরমি পর্যায়। আর এর ভেতরেই আমরা খুঁজে পাই দার্শনিক হাছন রাজাকে। হাছন রাজা সিলেটে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে সম্রাট অশোকের যেমন বোধোদয় হয়েছিল, ছেলেবেলার সেই ভূমিকম্প হাছন রাজার চিন্তারও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। হাছন রাজা প্রেমিক ছিলেন। একসময় তার প্রেমের গভীরতা মহাকাল স্পর্শ করে। হাছন রাজার গানগুলো শুনলেই আমরা দেখতে পাই আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। হাছন রাজার কাছে মনে হয়েছে মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, জগত নশ্বর। এক সময় স্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে। তাই স্রষ্টার সাধনা বিনা মুক্তি উপায় নেই। এই উপলব্ধি থেকে গেয়ে উঠেন, ‘আমি যাইমু ও যাইমু আল্লাহর সঙ্গে, হাছন রাজা আল্লাহ বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।’ কবি নজরুল গানে গানে যাকে বলেছেন, ‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর।’ এই মনোহরের কাছেই হাছন পেয়েছিলেন তার সব প্রশ্নের জবাব। অন্তরের নূরের ঝলক মনের চোখ দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। এরপর থেকেই তিনি মরমি কবি।
১৯০৭ সালে হাছন রাজা রচিত ২০৬টি গান নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাছন উদাস’। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাছন রাজার তিন পুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, হাছন রাজার অনেক গান এখনও সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাছনের অপর গ্রন্থ ‘শৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয় ছিল- স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। এ পর্যন্ত পাওয়া গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন হাছন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। হাছন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। সৈয়দ মুর্তজা আলীর ‘মরমি কবি হাছন রাজা’ রচনায় এক জায়গায় হাছন রাজার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘হাছন রাজা সুনামগঞ্জের একজন মুকুটহীন রাজা ছিলেন।’ হাছন রাজা সম্পর্কে বিশিষ্ট দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, ‘রাজা সুলভ সত্তায় একটি অতি কোমল দয়ালু মনের পরিচয় পাওয়া যায়।’ সুনামগঞ্জের আরেক প্রথিতযশা সাহিত্যিক গবেষক আবদুল হাই রচনা করেছেন ‘হাছন পছন্দ’ নামে একটি গ্রন্থ। হাছন রাজার দর্শন সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে ‘ওহফরধহ চযরষড়ংড়ঢ়যরপধষ ঈড়হমৎবংং’ এ বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, ব্যক্তি স্বরূপের সঙ্গে সম্বন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।’ এছাড়াও ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারে’ রবীন্দ্রনাথ ‘ঞযব জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ’ নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাছন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেন। এছাড়াও ২০০২ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় এবং চিত্র নায়ক হেলাল খানের প্রযোজনায় হাছন রাজার জীবনের ভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। চলচ্চিত্রটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আরও ছয়টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে এবং দুটি বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে।
বাউল সাধক হাছন রাজা ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর (২২ অগ্রহায়ণ ১৩২৯ বাংলা) মাত্র ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে মায়ের কবরের পাশে তিনি সমাহিত হন। যে কবরখানা মৃত্যুর পূর্বেই তিনি নিজে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। হাছন রাজার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে একটি জাদুঘর, যার নাম ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’। এখানে দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা হাছন রাজা ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে প্রতিদিন ভিড় করেন। এছাড়াও, সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়ায় এলাকায় সুরমা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হাছন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কালোত্তীর্ণ এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতার ও গানের পাণ্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগাপ্লুত করে।