১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার। এইদিন মুক্তিযোদ্ধা ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা চৌদ্দগ্রামের চার মাইল দক্ষিণে নানকারা নামক স্থানে পাকবাহিনীর ২৯তম বেলুচ রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানির একটি জিপকে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে পাকবাহিনীর ৬ জন সৈন্য নিহত ও ড্রাইভার আহত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বন্দী হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। ঢাকার ফার্মগেট এলাকার শত্রু চেক পোস্টে হামলা করে গেরিলারা তৎক্ষণাৎ ৪ পাকসেনা নিহত এবং পরে আরও ৫ জন মৃত্যুবরণ করে। ৫ সেনা আহত হয়। কুমিল্লার উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অংশে শত্রুদের অনেক অবস্থানে মুক্তিফৌজ এ্যামবুশ করে। তাদের অসংখ্য সেনা হতাহত হয়। শ্রীমান্তপুরে শত্রুদের আস্তানায় আক্রমণ হয়। এতে ১১ জন নিয়মিত সেনা নিহত হয়। একই দিনে একই স্থানে আরেকটি এ্যামবুশে আরও ৪ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। কোটেশ^র ও রাচিয়াতে আলাদা এ্যামবুশে ৪ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়। আনন্দপুর ও নারায়ণপুরের আরও ৪টি অবস্থানে এ্যামবুশ করা হয়। সেখানে যথাক্রমে ১২ ও ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। আশুগঞ্জ-সিদ্ধিরগঞ্জ লাইনে সরবরাহকারী বৈদ্যুতিক গ্রিডের দুটি পোল ধ্বংস করা হয়। ফলে আশুগঞ্জ-ঢাকা বিদ্যুত সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত এবং বন্ধ হয়ে যায়। একই দল ভৈরব-নরসিংদী-ঘোড়াশাল বাইপাস হয়ে কাজ করা আশুগঞ্জ-ঢাকা লাইনের ১০০০ কিলোওয়াট গ্রিড ধ্বংস করে দেয় এবং ভৈরব-ঢাকা টেলিফোন লাইনের দুটি করে মোট ৪টি পোল ধ্বংস এবং উপড়ে ফেলা হয়। সকাল ৭টায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল চৌদ্দগ্রামের ৪ মাইল দক্ষিণের নানকারা এলাকায় আক্রমণ করে। শত্রুবাহিনীর একটি চলন্ত জিপে হামলা চালিয়ে ড্রাইভারসহ ৭ জনকে হত্যা করা হয়। কানে গুলি খাওয়া এক পাঞ্জাবির কাছ থেকে জি-থ্রি রাইফেল এবং গোলাবারুদ দখলে নেয়া হয় এবং তাকে বর্ডারের দিকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সে মৃত্যুবরণ করে। রাত সাড়ে ১১টায় গেরিলা বাহিনী চৌদ্দগ্রামে ঢুকে মর্টার এবং এমএমজি ব্যবহার করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। সকাল পর্যন্ত চলা এই আক্রমণে শত্রুবাহিনীর অনেক সদস্য নিহত হয়। ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালত বিশিষ্ট চলচ্চিত্র শিল্পী কবীর চৌধুরী ও কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারকে ১৩ আগস্টের মধ্যে এবং ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মহসীন মন্টু, কামরুল আনাম খান খসরু ও আব্দুল গণি মনুকে ১৬ আগস্টের মধ্যে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপস্থিত না হলে তাঁদের অনুপস্থিতিতেই বিচার অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়। সামরিক আদালতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১৩ জন তরুণকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এরা হচ্ছেনÑ মোহাম্মদ ইদ্রিস (চাঁদপুর), আব্দুল ওহাব (দাউদকান্দি), আব্দুর রহমান (বেগমগঞ্জ), ভুলু (সেনবাগ), মুজিবুর রহমান (দেবীদ্বার), কালুগাজী, শফি, কাফী, সাদী, মান্নান, বারেক, খালেক ও শরাফত (সবাই ঢাকার রায়পুরার বাসিন্দা)। আদেশে নির্দিষ্ট সময়ে হাজির না হলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। সিলেট রেজিস্ট্রার ময়দানে ড. আবদুল মজিদের সভাপতিত্বে স্বাধীনতাবিরোধীদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আব্দুল লতিফ ফুলতলী, সাবেক মন্ত্রী আজমল আলী চৌধুরী। সভাশেষে রাজাকাররা কুচকাওয়াজ করে। এইদিন ওয়াশিংটন পোস্ট সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেন, পাকিস্তানে হিটলারের পরে সংগঠিত হওয়া সবচেয়ে বড় হত্যাকা-ের সাক্ষী হচ্ছেÑ আজকের বিশ্ব । হলোকাস্টের ফলে যখন শত সহস্র লোক মারা গেছে এবং কোটি লোক পালিয়ে গেছে, তখন পৃথিবী এসব আতঙ্কের দিকে শুধু তাকিয়েই দেখেছে প্রতিবন্ধীদের মতো তাদের জন্য করেছে সামান্যই। এই বেদনাদায়ক ঘটনাসমূহের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নিহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং বেঁচে থাকা লোকদের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি প্রদান করতে চেয়েছে পাশাপাশি তারা পাকিস্তানে হামলা চালানোর জন্য ভারতীয় বাহিনীকেও দায়ী করেছে। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লী একটি বিষয়ে খুবই সজাগ, আর তা হলো বাংলাদেশ বিষয়টি যেন কোনভাবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার একটি বিষয় না হয়। ইসলামাবাদ যখন দাবি করেছিল যে, বাংলাদেশের সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, তখন বিশ^ মানবতার উচিত ছিল হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। লাখ লাখ উদ্বাস্তু যখন ভারত আসছিল তখন এটা আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না। ভারত এটাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মেনে নিতে নারাজ। আশা করা হয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সঙ্গে সঙ্গে এ্যাকশন নেবে। এবং পাকিস্তানকে থামাতে চেষ্টা করবে। এটা শুধু মানবতার দিক থেকেই নয় পাশর্^বর্তী দেশের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের প্রতি হুমকি। পাকিস্তান ও তার বন্ধু দেশগুলো এখন বাংলাদেশ বিষয়কে তাদের পক্ষে নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক প্রভাব ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। ... মন্ডেল-ফ্রেজার সিনেটে যৌথ প্রস্তাবে বলেন মি. প্রেসিডেন্ট, ব্যাপক মৃত্যু ও দুঃখ-দুর্দশার এই বিশ্বে পূর্ব-পাকিস্তানের এই ভীতিকর পরিস্থিতির কোন সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় না। শত হাজার মানুষ রোগ, অনাহার ও সামরিক বাহিনীর পাশবিক নিপীড়নে মৃত্যুবরণ করে। এখন প্রায় ৭০ লাখেরও অধিক মানুষ চরম হতাশায় ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, আমেরিকার জনগণ এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির একটা বিশেষ ব্যাপার উপলব্ধি করতে পেরেছে- এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রতি আমাদের সরকারের অযৌক্তিক অবহেলা। মিথ্যা বর্ণনা আর অসার প্রতিশ্রুতি যা যুক্তরাষ্ট্র করে এসেছে যখন তারা পূর্ব পাকিস্তানের দমনমূলক সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করছিল আর লক্ষাধিক মানুষ নিপীড়িত হওয়া সত্ত্বেও তারা নির্মম নীরবতা বজায় রেখেছিল। ... সিনেটর পিয়ারসন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে প্রদত্ত বক্তৃতায় বলেন, আমেরিকানদের জন্য হাজার হাজার মানুষের অনাহারে অকারণ বীভৎস মৃত্যুর মাঝে চুপচাপ বসে থাকা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তানে অনাহারে মানুষের অনর্থক মৃত্যু আমেরিকার জনগণের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে, সম্ভবত যার প্রভাব দৃষ্টি আকর্ষক বাইজেন্টাইনের চেয়েও বেশি । মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কি পাকিস্তানের জনগণকে এ কথা বোঝাতে ব্যর্থ হওয়া উচিত যে আমেরিকার অনেক মানুষ এই অপ্রয়োজনীয় অনাহার ও মানুষের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞকে উপেক্ষা করতে পারছে না? কংগ্রেস, আইনসঙ্গতভাবেই, পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যকে বন্ধ করার প্রয়োজন বোধ করতে পারে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশে বলা হয়েছে পূর্ব বাংলায় সেনা নিপীড়ন, যার ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন স্থগিত হয়েছে, সেটির প্রভাব শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানেও প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছে, এবং যার কারণে এ সবকিছু হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, জনাব ভুট্টো, যাঁকে সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবেই মনে করা হয়। সেনাবাহিনী আর ভুট্টো মিলিতভাবে এ বছরের শুরুতে ১৯৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে পাকিস্তানের ফিরে আসা ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। সে সময় এটা বোঝাই যাচ্ছিল, ভুট্টো যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের ইচ্ছা সেনাবাহিনীর ইচ্ছার অনুরূপ ছিল। তাদের যৌথ লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার কার্যকরী হস্তান্তর অগ্রাহ্য করা। এ পদক্ষেপের পেছনে অনেকগুলো মূল কারণ ছিল; এর মধ্যে ছিল এ ভয় যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ক্ষমতার সমীকরণে ব্যাপক রদবদল ঘটবে, সেনাবাহিনী তার অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন হারাবে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এতদিন টিকে ছিল যে ভারতবিদ্বেষী প্রচারণার উপর, সেটি তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে। আওয়ামী লীগকে সমীকরণের বাইরে রাখলে দুটো ঘটনার মধ্যে একটি হবে, হয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল, তারই পিপলস পার্টির হাতে ক্ষমতা আসবে, অথবা পূর্ব বাংলা সামরিক শাসনে চলবে আর পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তত চারটি প্রদেশে প্রতিনিধি সরকার পুনর্বহাল হবে, ভুট্টো খুব সম্ভবত এই ভরসায় ছিলেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাঁর পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল দুটো প্রদেশ, পাঞ্জাব ও সিন্ধুর ক্ষমতা পেত। কিন্তু কার্যত হিসাবে ভুল হলো। যতদিন জেনারেল ইয়াহিয়ার হিসাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলায় ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফেরত না আসবে ততদিন পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তিনি অস্বীকৃতি জানালেন। এ রকম কোন ‘স্বাভাবিক’ অবস্থার আশু সম্ভাবনা না থাকায় ভুট্টোর হতাশা বাড়ল। তাছাড়াও, ক্ষমতা হস্তান্তরে দেরির ফলে তাঁর দলের ভেতরে অস্থিরতার লক্ষণ দেখা যেতে লাগল। সবকিছু মিলিয়ে, ভুট্টো ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে আরও উচ্চকণ্ঠ হলেন, যা সামরিক শাসকগোষ্ঠীর জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠতে লাগল। প্রতিবেদনে প্রকাশ, তেহরানে এক ইরানি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাতকারে, ভুট্টো বলেছেন যে, পাকিস্তানের সমস্যার অবশ্যই রাজনৈতিক সুরাহা হতে হবে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত দল আওয়ামী লীগকে এতে অংশ নিতে হবে। তিনি বেসামরিক শাসনের আশু প্রত্যাবর্তনও দাবি করেছেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
[email protected]
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: