ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

জি না, এটা ভারত বন্দনা না

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ৮ অক্টোবর ২০১৮

জি না, এটা ভারত বন্দনা না

ভারতীয় দূতাবাসের আমন্ত্রণে এবারের সিলেট যাত্রাটা ছিল সহসাই। যাবার দুইদিন আগে সন্ধ্যায় হঠাৎই দূতাবাসের বন্ধুস্থানীয় কর্মকর্তার ফোনে আমন্ত্রণ। ভারতীয় দূতাবাস দীর্ঘদিন ধরেই মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বৃত্তি প্রদান করে আসছে। স্বীকার করতে বাধা নেই, বিষয়টা আমার জানা ছিল না। দূতাবাস কর্মকর্তার ফোনেই প্রথম জানলাম। এবারের আনুষ্ঠানিকতা সিলেটে। বৃহত্তর সিলেট আর কিশোরগঞ্জ জেলার দুই শ’ জনেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে বৃত্তির চেক তুলে দেয়া হবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে। ভারতীয় দূতাবাস এ পর্যন্ত এ বাবদ ২২ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে। অনুমোদন আছে আরও ৩০ কোটি টাকার। অনুষ্ঠানের দিন অডিটরিয়ামে বসে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। অডিটরিয়াম ভরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা আর তাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম। দূতাবাসের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমার অবস্থান সামনের কাতারে। খুব সঙ্কুচিত লাগছিল নিজেকে। দেশ শ্রেষ্ঠদের এই আসরে উপস্থিত থাকতে পারাটা বড় বেশি সম্মানের। আনুষ্ঠানিকতা চলছে উত্তরীয় পরানো, বক্তৃতা, পটের গান আর অবশ্যিই বৃত্তির চেক বিতরণ। আর আমি ভাবছি কি গভীরেই না প্রোথিত এই সম্পর্ক। একাত্তরের নয়টি মাসে এক কোটিরও বেশি বাঙালী বাঁচার তাগিদে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। এক কোটির এই সংখ্যাটি আমাদের সবার জানা। এটা বার বার উঠে আসে লেখায়-আলোচনায়। যা উঠে আসে না তা হলো এই এক কোটিকে সীমানা পেরোতে দিয়ে ভারত সেদিন কি মারাত্মক ঝুঁকিটাই না নিয়েছিল। ওরা যে একদিন আবারও সীমানার ওপারে নিজেদের ঘরে ফিরে যাবে এমন সম্ভাবনা তো ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। আমরা এখনও আশাবাদী যে আমরা আলোচনার মাধ্যমে এদেশে আশ্রয় নেয়া দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে কোন একদিন মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারব। তবে আমরা এও জানি যে, এটি সহসা ঘটার না। যে কোন শরণার্থী সমস্যার ক্ষেত্রেই এ কথাটি প্রযোজ্য। এতে লাগে বছরের পর বছর, মাসের পর মাস। আজকের যে এশিয়া কাপ মাতানো আফগান ক্রিকেট দল, এদের সবার জন্মই পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে। শরণার্থী জীবনে ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে আর খেলতে খেলতে একটা জাতি ক্রিকেটিং নেশনই বনে গেল অথচ শরণার্থী জীবনের শেষ হলো না। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর আমাদের প্রিয় নেত্রীর শরণার্থী জীবনও ছিল প্রায় অর্ধযুগের। এটাই শরণার্থীর জীবনের বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতা জেনে-শুনেই ভারত সেদিন এই বিরাট বোঝাটা কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তাদের সামনে কিন্তু চ্যালেঞ্জটা ছিল আরও বড়। আমাদের লক্ষ্য মিয়ানমারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রোহিঙ্গাদের সেদেশে ফেরত পাঠানো। আর ভারতের বেলায় চ্যালেঞ্জটা ছিল পাকিস্তানকে যুদ্ধে হারিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাঙালী শরণার্থীদের একটি নিরাপদ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা। কাজটা শুনতে যতটা সোজা বাস্তবে ছিল ততটাই কঠিন। সামনে ছিল পৃথিবীর চতুর্থ ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী, যাদের পেছনে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মতো পরাশক্তি। তার উপর বাঙালীদের যুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ ছাড়াও সেই লক্ষ্য অর্জন ছিল অসম্ভব। ভুলে গেলে চলবে না এর আগের দুটি পাক-ভারত যুদ্ধের ফলাফল ভারত কিন্তু তাদের অনুকূলে আনতে পারেনি। আজকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় যে সামাজিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে তা আমাদের উদ্বেগের কারণ। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাবিষয়ক সাম্প্রতিক একাধিক গোল টেবিল বৈঠকে এমনটাই আলোচনায় উঠে আসতে দেখেছি। রোহিঙ্গাদের কারণে দেশের ওই দুটি উপজেলার পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা এক কথায় অপূরণীয়। পাশাপাশি সংখ্যালঘু স্থানীয় বাঙালী জনগোষ্ঠীর আয়, জীবনাচার আর সামাজিকতাও এক কথায় খোলনলচে পাল্টে গেছে। এখন একবার ভাবুন তো, আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যটির কথা, যেখানে একাত্তরে বাঙালী শরণার্থীর সংখ্যা পুরো রাজ্যটির মোট জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। আজকের যে রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের জীবনযাত্রাকে উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে তাদের আর স্থানীয়দের জীবনাচার। ভারত কিন্তু একাত্তরে এই ঝুঁকিটাও নিয়েছিল। বাঙালী শরণার্থীর বাঁধভাঙ্গা ঢলে পাল্টে গিয়েছিল ভারতের সীমান্তবর্তী একাধিক রাজ্যের জনসংখ্যার এমনি নানা মৌলিক চরিত্রগুলো। আমরা প্রায় বুঝে না বুঝে বলে বসি ভারত একাত্তরে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দুর্বল করে দেয়ার জন্য। আমরা শুধু ভুলে যাই যে, কাজটা মোটেও এত সহজ ছিল না। বিভক্ত পাকিস্তান আর সামরিকভাবে দুর্বল পাকিস্তান যে একে অপরের সমার্থক নয় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ একাত্তর পরবর্র্তী সময় পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন। আর পাকিস্তানের ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম তা কি নানা সময় ভারতের জন্য গলার কাটা হয়ে উঠেনি? একটি স্বাধীন বাংলাদেশ যে কখনও কখনও ভারতের জন্য কত বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি তার প্রমাণ দুবাইয়ে এ দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ভারতের শীর্ষস্থানীয় ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর বৈঠকে, আটক দশ ট্রাক অস্ত্রের পরতে পরতে আর অরবিন্দ রাজখোয়াদের এদেশ থেকে ওদেশে পুশব্যাকের প্রতিটি ধাপে বিধৃত। ১৯৭১-এর পর মুজিব-ইন্দিরা আর তারপর দীর্ঘ বিরতিতে হাসিনা-মনমোহন ও হাসিনা-মোদি সহযোগিতা আর পারস্পরিক আস্থা এই দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ককে অন্য মার্গে উত্তীর্ণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারতের আজকের যে সম্পর্ক তা এক কথায় রূপকথার। বাস্তবে আজকের পৃথিবীতে এমনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দ্বিতীয় কোন উদাহরণ অন্তত আমার জানা নেই। অনেকেই আমার এই লেখাকে অনেকভাবে বিশ্লেষণ করবেন। কেউ বলবেন ট্রান্সশিপমেন্ট আর ট্রানজিটের সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ তো ভারতের সীমান্তবর্তী ‘সাত বোনের’ চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। কেউ আবার বলবেন ভারত থেকে বাড়তি বিদ্যুতটুকু আমদানি করে আমরা তাদের কম বৈদেশিক মুদ্রা দিচ্ছি নাকি। আজকের বাংলাদেশে অরবিন্দ রাজখোয়া আর পরেশ বড়ুয়াদের প্রশ্রয় নেই বলে ভারতের উত্তর-পূর্বে শুধুই শান্তি, এমন উদাহরণও টেনে আনবেন অনেকেই। যুক্তি দেবেন এমনিতর নানা কারণেই বর্তমান সরকারের প্রতি ভারতের অমন সমর্থন। আমার কাছে এই বিষয়গুলো এত সরল না। একজন নরেন্দ্র মোদি কিংবা একজন মমতা ব্যানার্জির দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থ আর দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধে উঠে একজন শেখ হাসিনার প্রতি যে অগাধ শ্রদ্ধায় সিক্ত ভালবাসা তার কারণ, ‘শেখ হাসিনাই বাংলাদেশ’ এবং সেটি এমন একটি বাংলাদেশ যার অর্জন আর উদারতা পরিমাপের অতীত। আজকে ইউরোপীয় নৌবাহিনীগুলো যখন সিরিয়া আর লিবিয়ার শরণার্থী বোঝাই নৌকাগুলো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে একজন শেখ হাসিনা দশ লাখ রোহিঙ্গাকে বুকে টেনে নিচ্ছেন অকৃত্রিম ভালবাসায়। একজন শেখ হাসিনা আজ বঙ্গবন্ধু, বাঙালী আর বাংলাদেশের সমার্থক। আমি বিশ্বাস করি, কোন ষড়যন্ত্র, লবিস্ট, ভাঙ্গা স্বপ্নের গল্প, অর্থ এসবের কোন কিছুই এই সম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারবে না। এখন এখানে-সেখানে অনেক গল্পই শুনি। ভারত-বাংলাদেশের আজকের সম্পর্কটা যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমার আস্থায় ভিত্তিটা সেখানেই। এই লেখাটা পড়ে কেউ কেউ এটাকে ভারত বন্দনা বলতেই পারেন। আমি বলব, ‘জি না, এটা ভারতের বন্দনা মোটেই না’। বিনা যুদ্ধে বাংলাদেশের স্থল আর সমুদ্রসীমা সম্প্রসারণে সাম্প্রতিক ভারতীয় নেতৃত্ব যে ‘বাংলাদেশ বন্দনার’ পরিচয় দিয়েছেন, আমি বলব এটা তো সেই তুলনায় নস্যি। ‘বন্দনা’ সবকিছুর সমাধান না, ব্যাখ্যাও না সবকিছুর। এই বাস্তবতাটা যত তাড়াতাড়ি আত্মস্থ করা যায় ততই মঙ্গল। লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×