ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

দেশে-বিদেশে ছাত্ররাজনীতির ভিন্নতা

ড. শামীম আহমদে

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

দেশে-বিদেশে ছাত্ররাজনীতির ভিন্নতা

ড. শামীম আহমদে

গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠেছে। এই আন্দোলনের শুরু হয় কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে যা এখন আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, এমআইটি, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিসহ এক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দখল করেছে ইসরাইলের সঙ্গে যে কোনো ধরনের একাডেমিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য।

আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখাদেখি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ করা শুরু করেছে। আমি গত কয়েকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এই বৈশ্বিক আন্দোলন গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছি। এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই ইহুদি ধর্মাবলম্বী, তারা তাদের বক্তব্যে বলেছে, ইসরাইল গাজায় যা করছে, তা তাদের ইহুদি ধর্মের অংশ নয়।

আমেরিকায় ইহুদি ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা যখন গাজার মুসলমানদের গণহত্যার প্রতিবাদ করে, ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার প্রতিবাদ করে, ঢাকার মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা মন্দিরে হামলার প্রতিবাদ করে, রাশিয়ার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করে- তার চাইতে সুন্দর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না। আমেরিকায় শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রমাণ করে মানবতা ধর্মের চাইতেও বড়।

এমন মানবতাই ধর্মকে প্রতিরক্ষা দেয়। বাংলাদেশের লাখ লাখ অভিভাবক যেখানে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে আমেরিকার আইভি লীগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের সন্তানদের পড়তে পাঠানোর স্বপ্ন দেখেন; সেখানে সেইসব আইভি লীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিজেদের আরাম-আয়েশ ছেড়ে কোথাকার কোন্ ফিলিস্তিনের মানুষের পক্ষে রাস্তায় নেমে নিজেদের জীবন এবং পেশা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে! সত্যি বলতে কী মানবতার পক্ষে এই আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের এই ঘুরে দাঁড়ানোর চাইতে সুন্দর দৃশ্য আর নেই।

দুর্ভাগ্য যে, মুসলিম অধ্যুষিত কোনো দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমেরিকার কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা আন্দোলন করতে পারল না। পারল না আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল বা বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও। তারা যখন ঘরে বসে আমেরিকার এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, সেখানকার শিক্ষার্থীরা একই সময়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়েছে।

ইসরাইলের অভ্যন্তরে হাজার হাজার মানুষ তাদের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। ইসলামের ধারক-বাহক সৌদি, দুবাই, ইরানকে এমন প্রতিবাদ করতে দেখলাম না। এই যে নির্যাতিত মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের বৈশ্বিক আন্দোলন- এর চাইতে সুন্দর বিষয় আর কিছু নেই। 
গাজার নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের জন্য, স্বাধীন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের জন্য এই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আমাদের নানা কথা মনে করিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কি কেবলই গ্রাজুয়েট তৈরি করা? হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি, ইয়েল, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, ম্যাকগিল, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ম্যাকমাস্টার, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, মোনাশ, মেলবোর্ন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়তে যান, তারা এমনিতেই মেধাবী। পড়ালেখার বিষয়গুলো তারা নিজেদের নিয়মমাফিকই করতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শুধু তাদের জ্ঞানের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। একই কথা প্রযোজ্য হওয়া উচিত আমাদের বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট কিংবা ঢাকা মেডিক্যালের শিক্ষার্থীদের জন্য। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার কথা না। আর যদি তারা সুযোগ পায়, সেক্ষেত্রে জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াটা ইতোমধ্যেই তাদের জন্য সহজ, শিক্ষকরা কেবল তাদের সঠিক রাস্তাটাই দেখিয়ে দেবেন।

আমি মনে করি ক্লাসে যাওয়া, ক্লাস করা, পরীক্ষায় ভালো করা জরুরি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য নয়। বিষয়ভিত্তিক টেকনিক্যাল নলেজের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা হয় স্কুল-কলেজে। সেই প্রস্তুতি যদি সঠিক হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নেতৃত্ব তৈরি করা, মানবিক গুণাবলি শাণিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের উন্মেষ করবে, নিজেকে ছাড়িয়ে যাবে, অন্যায়ের অহিংস প্রতিবাদের ভাষা শিখবে, নিজেকে নিজের গ-ির বাইরে নিয়ে সারাবিশ্বের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করবে, তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় কেন বিদ্যালয় হিসেবে পরিগণিত হবে না? 
আমাদের দেশে সম্প্রতি ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠেছে এবং এই জন্য মানুষকে এককভাবে দায়ী করার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ইসরাইলের পরিচালিত যে গণহত্যা, সেটি প্রকৃত ছাত্ররাজনীতি। আমাদের দেশে নেতাদের চাটুকারিতা, হল দখল, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ভোটকেন্দ্র দখল, সাধারণ মানুষকে হেনস্তা, অন্য দলের শিক্ষার্থীদের খুন করায় ছাত্ররাজনীতিবিদদের যে সংশ্লিষ্টতা, তাতে করে ছাত্ররাজনীতির একটি কলুষিত চেহারা মানুষের মনের ভেতর গেঁথে গেছে।

ছাত্ররাজনীতির ভালো দিকগুলো তুলে ধরতে হলে এখন আমাদের ১৯৭১-এ ফিরে যেতে হয়, এরশাদ পতনের কথা বলতে হয়, ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের কথা বলতে হয়। সরকার পতন এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে ছাত্ররা এত সক্রিয় হতে পারে, তারা কেন দেশের ভেতর চলমান অব্যবস্থাপনা নিয়ে বক্তব্য দিতে পারে না? রুখে দাঁড়াতে পারে না? এর একটিই কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, তা চালিত হচ্ছে তাদের বিবেক দ্বারা।

সেখানে দলীয় লেজুড়বৃত্তি নেই, আন্দোলনের জন্য অর্থ বরাদ্দ নেই, ভবিষ্যৎ কোনো লোভনীয় পদের হাতছানি নেই। কোনো বিরোধী দল সরকার পতনের জন্যেও তাদেরকে অর্থ দিয়ে মাঠে লেলিয়ে দেয়নি। বরঞ্চ শিক্ষার্থীরা অন্যায় দেখে রাস্তায় নেমেছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যতদিন দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে সাধারণ মানুষ, বিশ্ব নাগরিকের ইসু নিয়ে রাস্তায় নামবে না, ততদিন আমাদের ছাত্ররাজনীতি মানুষের কাছে তাদের হারানো অবস্থান ফিরে পাওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্ব কারা দেন, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের কোনো আন্দোলনে যদি এমন কোনো ছাত্র নেতৃত্ব দিতেন, যিনি কোনো একটি বিষয়ের প্রথম শ্রেণি পাওয়া শিক্ষার্থী, চার বছরের কোর্স চার বছরে শেষ করেছেন, তবে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা শ্রদ্ধা প্রকাশ পেত। কিন্তু আমাদের অনেক ছাত্রনেতা বছরের পর বছর হলো কামড়ে ক্যাম্পাসে পড়ে থাকেন, তাদের পড়ালেখার অগ্রগতি লজ্জাস্কর, তাদের আচরণ অগ্রহণযোগ্য।

আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্ররাজনীতি থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আর জাতীয় রাজনীতির প্রধান দলগুলো যতদিন মনে করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল ছাড়া ক্ষমতায় থাকা যায় না, ততদিন পর্যন্ত আমাদের ছাত্ররাজনীতির চেহারা পাল্টাবে বলে মনে হয় না।

৩০ এপ্রিল ২০২৪

[email protected]

×