ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দায় কার

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২১:০২, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দায় কার

সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক লোমহর্ষক নৃশংসতা

সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক লোমহর্ষক নৃশংসতা, যা সারাদেশের জন্য এক চরম দুর্বিপাক। সত্যিই জানমালের ওপর অসহনীয় নির্মম বিপর্যস্ত পরিস্থিতির দুর্ভোগ বললে বেশি বলা হবে না। তারপরও প্রতিদিন দুর্ঘটনার মিছিলে সারাদেশ বিপন্ন হওয়ার বেহাল অবস্থায়। গ্রীষ্মের চরম খরতাপে একদিকে যেমন সার্বিক জনগোষ্ঠীর নাভিশ্বাস, বিপরীত দিকে সড়কে চলছে অনাকাক্সিক্ষত চরম দুঃসময়।

এমন একটি দিন অতিবাহিত হয় না যেখানে এই দুঃসহ দুর্বিপাক সংশ্লিষ্টদের বিপাকে ফেলে না। বহুবার ঘটে যাওয়া এসব আকালের কোনো সুষ্ঠু সমাধান আসে না। বরং দুর্ঘটনার কারণ নির্দিষ্ট হওয়ার পরও প্রতিকারের পথ যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কত মানুষের জানমাল নিঃশেষে ধূলিসাৎ হওয়া ছাড়া ফি বছর তা বেড়ে যাওয়াও উদ্ভূত পরিস্থিতির চরম বেহাল দশা। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে উঠে এসেছে- খোদ অ্যাম্বুলেন্সই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে স্বীয় রক্ষাকবচকেও যেন ব্যঙ্গ করে গেছে।

তেমন অনাকাক্সিক্ষত বিসদৃশও সড়কের নির্মম যাতনা। বারবার সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে অদক্ষ চালকদের বিষয়ে। মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রযান, বেপরোয়া গতি, তার সঙ্গে সড়ক-মহাসড়কের অনিরাপত্তা যুক্ত হওয়াও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিকে চরমভাবে উস্কে দিচ্ছে। এমন সব অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনাকে যথার্থ কর্মযোগে ফেরাতে আর কত কঠিন রাস্তা পাড়ি দিতে হবে তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়।

আর ক্ষুদ্র যান মোটরসাইকেল তো আছেই। সড়কের হরেক মাত্রার বিপন্ন তৈরিতে নিজেদের সম্মুখ সমরে হাজির করছে এসব যান। চলতি মাসের ১৩ তারিখেই ঘটে যায় এক অবর্ণনীয় দুর্দশা, যা চুয়েটে দুই শিক্ষার্থীর জীবন কেড়ে নেয়। তার দাম দিতে হচ্ছে অসহায় দুই পরিবারের নিকটজনদের। উদীয়মান সম্ভাবনাময় দুই প্রকৌশলী শিক্ষার্থীর জীবন অকালে ঝরে যাওয়া কোনোভাবেই মান্যতা, ন্যায্যতা পেতে পারে না। সেই ক্ষুদ্র বাইক আর বিরাট যন্ত্রদানব বাসের বেপরোয়া গতির অদম্য নৃশংসতায়।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বাসের ধাক্কায় চুয়েটের দুই প্রতিভাবান ছাত্রের জীবন বলি হলো যন্ত্রদানবের চরম গাফিলতি আর ঔদ্ধত্য গতির বেপরোয়া ধাক্কায়। শুধু কি উদীয়মান দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু, সঙ্গে তছনছ দুই পরিবারের স্বপ্নের পরম আকাক্সক্সক্ষাও। তার পরে যা হওয়ার তাই ঘটে চলেছে আজ অবধি। সংশ্লিষ্ট সড়ক আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু উত্তালই নয়, বরং বিচারের দাবিতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য লড়াই করতেও থেমে থাকছে না। বরাবরের মতো একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি।

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল আর সুষ্ঠু তদন্তের সুউচ্চ আওয়াজে সড়কে দেখা গেছে উত্তাল হাওয়া। এমন বহু প্রতিবেদন সংবাদপত্রে নিত্য খবর হয়। কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি কিংবা বিচারের আওতাধীন করার বিষয়টি আড়ালে-আবডালেই থেকে যাচ্ছে। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্য পথদুর্ঘটনা। অসহনীয় মৃত্যু আর সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হওয়ার সারি দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। 
বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে ঘুম চোখে চালকের গাড়ি চালানোর বিষয়। এছাড়াও বিধি-বিধানকে তোয়াক্কা পর্যন্ত না করেই অদক্ষ চালকের হাতে ঘাতক যন্ত্রযানকে সোপর্দ করা হয়। তারও আগে ফরিদপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে ১৫ জনের নিহত হওয়ার যে অপদৃশ্য সংশ্লিষ্টদের মর্মাহত করে দেয় সেটার যথার্থ শাস্তি কিংবা বিচার আদৌ হবে কি না তা শুধু সময়ের হাতে। ঈদের সময় যন্ত্রযান চালকদের দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোও এক বড় বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সঙ্গত কারণে ক্লান্তি, অবসাদে দুচোখের পাতা বুঁজে আসাও এক অপরিণামদর্শিতার চরম প্রতিক্রিয়া। তার ওপর আছে সড়ক-মহাসড়কে দৃশ্যমান অপরিকল্পিত খানাখন্দক। উন্নয়নের মহাসড়কে সারাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি বিপরীত প্রতিক্রিয়াকে সামলাতেও হিমশিম খাওয়ার চরম দুরবস্থা। এখনো অপরিকল্পিত বহু সড়ক-মহাসড়ক সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে না পৌঁছানোর যে দুর্গতি সেখানে প্রচ্ছন্ন থাকে আরও নানামাত্রিক অপঘাত।

সড়কের মধ্যে যে গতি নিরোধক ব্যবস্থাপনা তাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অকার্যকর অবস্থায় দৃশ্যমান হয়। চালক হুমড়ি-ভিরমি খেয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাও উদ্ভূত বেসামাল পরিস্থিতির সীমাহীন যন্ত্রণা। নতুন কোনো চিত্র সেভাবে উঠেও আসে না। আগের অব্যবস্থাপনা জিইয়ে থাকাও নিয়ম বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মতো আর এক বিপাক তো বটেই। ঈদুল ফিতরের দীর্ঘ যাত্রার আগেই এমন সব অসহনীয় অপদৃশ্য সংবাদপত্রের খবর হয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার তাগিদও এসেছে।

কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি কোনোভাবেই সামলানোর অবস্থায় থাকে না। বিশেষ করে দুই দীর্ঘ ঈদযাত্রায় পরিস্থিতি কেমন যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নাড়ির টানে নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার যে অনন্য ভাবনা সেখানে কতজনের জীবন যে তছনছ হয় তা হিসাবেও আনা যায় না। তার সঙ্গে স্বপ্ন পুড়ে ছারখার হয় সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর। সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে যাওয়া চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর পরিবারসহ সহপাঠীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে একাত্ম হলেও সর্বশেষ সমাধান কোথায় গড়াবে তাতে নিশ্চিত কোনো লক্ষ্যমাত্রার ঘাটতি উদ্ভূত শোকাবহ দুর্ঘটনার চরম বিপন্নতা।

গত ২৩ এপ্রিলেও কুমিল্লায় বাসচাপায় একই পরিবারের চারজনের নৃশংস মৃত্যু কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো। দাউদকান্দি উপজেলায় রাস্তা পারাপারের সময় এমন দুঃসহ দুর্ঘটনা হতভম্ব করে দেয়। দোষ চালকের নয় পথচারীর তেমন বিচারের কোনো দরকারই পড়ে না। কারণ চালক সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। দীর্ঘ যাত্রায় চালকদের ক্লান্তি-অবসাদে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াও এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

বাস্তব ঘটনা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে প্রতিকার কিংবা প্রতিবিধানের যথার্থ পথ খুঁজে বের করাও বিপরীত পরিস্থিতির ন্যায্যতা। অনেক চালক নিজেও দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়। তেমন দুর্দশাও চোখে দেখার মতো নয়। দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া এমন সব অসহনীয় দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রতি বছরেই বাড়ছে, যা বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দৃশ্যমান হয়। ২০২২ সালে সড়ক, নৌ ও রেলপথের দুর্ঘটনার যে চিত্র তাতে দেখা যায় মোট ৭০২৪টি অঘটনা ঘটে সড়কে।

২০২১ সালে তেমন সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার। তার মানে প্রতি বছরই এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার দুর্যোগই বলা যায়। তবে দুর্ঘটনার জন্য সব সময় যে চালকই দায়ী থাকে তেমনটা নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতিই চালকের ওপর দায়ভাগ চাপিয়ে দেয়। আর বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য দুর্বিপাককে আড়াল করতেও চালককে সামনে হাজির করা হয় উপস্থিত ঘটনার জন্য। সড়কে যখন যানবাহন চলে তখন চারপাশের পরিস্থিতিও নজরে আনা উচিত।

আমাদের সড়ক-মহাসড়কের ব্যবস্থাপনায় কত যে অসঙ্গতি ভেতরে জিইয়ে থাকে তাও বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে। চারপাশের হরেক দৃষ্টিকটু আলামত ও বিপন্ন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করে দেয়। ট্রাফিক আইন মেনে চলা শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়-দায়িত্ব নয়, সেইসঙ্গে চারপাশের সবারই সচেতন দৃষ্টিও কাম্য। যানবাহনের চালক যেমন ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য, একইভাবে পথচারীকেও সচেতন সাবধানতায় লাল-সবুজ বাতি দেখে রাস্তা পারাপার হওয়াও নিতান্ত বাঞ্ছনীয়। সড়কের নির্দিষ্ট জায়গায় পথচারী সেতু দৃশ্যমান।

সেটার সময়োচিত ব্যবহার ও সংশ্লিষ্টদের সচেতন দায়িত্বের ওপরই বর্তায়। তবে পথযাত্রীদের পদচারী সেতু ব্যবহার না করার যে নিয়মবহির্ভূত আচরণ তাও শুধু আইন ভঙ্গ করাই নয়, দৃষ্টিকটুও বটে, যা এক প্রকার সড়ক দুর্ঘটনাকে আলিঙ্গন করার মতোই। তবে সারাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় পদচারী সেতুর সংখ্যা এতই অপ্রতুল যে, সেটাও দুর্ঘটনা বাড়াতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা।

আবার রাস্তা পারাপারের জন্য সেতু থাকা সত্ত্বেও চোখের সামনেই সেতুর নিচ দিয়ে মানুষ ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার করছে। এমন অপদৃশ্য দেখে আঁতকে যাওয়ার দুরবস্থা। সব মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধও একান্ত জরুরি। আপন ইচ্ছায় ঝুঁকিমুক্ত পথ হিসেবে পদচারী সেতুর প্রতি মানুষের আগ্রহ যত বাড়বে ততই মঙ্গল। দুর্ঘটনার হারও কমে আসতে সময় লাগবে না। তবে দুর্ঘটনা জিইয়ে থাকার উৎস যেমন বড় বড় যন্ত্রযান (বাস-ট্রাক), একইভাবে ক্ষুদ্র বাইকও পরিস্থিতিকে বেসামাল করতে যেন এগিয়েই থাকে।

ক্ষুদ্র যন্ত্রযানে চালক কিন্তু দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বেপরোয়াভাবে যেন বাইকের গতিকে ঊর্ধ্বগতি করতে একেবারে নিজেকে সমর্পণ করে বলা যায়। মোটারসাইকেল দুর্ঘটনা ও মৃত্যু যেন পাশাপাশি অবস্থান করে। সংশ্লিষ্টরা বুঝেও অবুঝের মতো চালিয়ে যায় ভয়ডর উপক্ষো করে উ™£ান্তের নেশায়। লোমহর্ষক সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আবশ্যক।

হয়তো খুব দ্রুত এসব রোধ করা সম্ভব নয়। তাই বলে দুর্ঘটনা রোধের চেষ্টা না করে বিষয়টিকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সকলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চলমান দুর্ঘটনা সামাল দিতে নিয়ামকের ভূমিকা রাখবে- এই প্রতাশা।
লেখক : সাংবাদিক

×