ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ॥ এক বহুমাত্রিক দার্শনিক

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বঙ্গবন্ধু ॥ এক বহুমাত্রিক দার্শনিক

পলাশী প্রান্তরের নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকা-ের চেয়েও জঘন্যতম ঘটনা হলো ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনার আর কোন দৃষ্টান্ত নেই। যে পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করতে সাহস পাননি, সেই পাকিস্তানীরাই কিছু বাঙালী কুলাঙ্গারের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেন। জাতির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের বিচার এ দেশের মাটিতে হয়েছে। আরও বিচার হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর ও প্রত্যক্ষ গণহত্যায় জড়িত পাকিস্তানী দালালদের। বঙ্গীয় সমতটের মানুষগুলো প্রাকৃতিক কারণেই ছিল স্বাধীনচেতা। হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাঙালী এ জাতিগোষ্ঠীর মননে এবং ঐতিহ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে। প্রাচীন রাজ-রাজড়াদের আমল থেকে নিকট অতীতের পাল, মুঘল, নবাব, ইংরেজ শাসিত গৌড়, রাঢ়, বঙ্গসম আমলেই বাঙালীর স্বাধীনচেতা মননের পরিচয় পাওয়া যায়। সম্ভবত বাংলার ‘বার ভূইয়া’ খ্যাত আঞ্চলিক শাসক-নৃপতিদের শাসন ব্যবস্থা ও শাসনের ধরন থেকেই এর পরিচয় আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রভাবে এ জনপদের মানুষের মাঝে যেভাবে স্বাধীনচেতা মনোভাব বিরাজমান তা আর কোথাও তেমন প্রকট নেই। তাই কঠিন-কোমলে, আবেগে, উদাসী মনের মানুষের মিলনমেলা এ বঙ্গদেশে। এ জাতির চিন্তা-চেতনার সবটুকু ধারণ করেই হাজার বছর পর এক পরিপূর্ণ এবং শাশ্বত বাঙালীর রূপ ধারণ করে জোয়ার-ভাটার প্লাবন ভূমিতে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আজকের বৃহত্তর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আবির্ভূত হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের তথা তদানীন্তন পূর্ব বাংলার এক নিভৃত পল্লী বা অজপাড়াগাঁয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একটি সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন। জন্মের পর অতি কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর চারপাশের হতদরিদ্র মানুষের কঙ্কালসার ছবি। হয়ত প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁর মননে এ দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলোর দুঃখ-বেদনার প্রতিচ্ছবি গ্রথিত হয়েছিল। তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর সারা জীবনের রাজনীতি, ধ্যান ও জ্ঞানে। জীবনে শিক্ষার প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন এ দরিদ্র সর্বহারা মানুষের জীবনাচার থেকে মানুষের বেঁচে থাকার করুণ আর্তনাদের অনুচ্চারিত, অব্যক্ত ধ্বনির মধ্যে। সেদিনই প্রাকৃতি পাঠের প্রথম অধ্যায়ে তাঁর জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য স্থির হয়ে গিয়েছিল। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন মানুষের মানবতার মুক্তির। প্রচলিত একটা কথা আছে ওভ ুড়ঁ ফড়হ’ঃ যধাব ধ ফৎবধস, যড়ি ধ ফৎবধস পড়সব ঃৎঁব? এখানেই ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। কালামজীর মতে জীবনের লক্ষ্য ২০ বছরের মধ্যে স্থির করতে হবে, যা বঙ্গবন্ধু স্থির করেছিলেন তারও আগে। এ সত্যটা তাঁর জীবনে চরম সত্যে পরিণত হয়েছিল। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন শিশু-কিশোর জীবনে। চঞ্চল আবেগপ্রবণ কৈশোর স্বপ্ন দেখার সবচেয়ে বড় সময়। কবিরা স্বপ্ন দেখেন, তাদের দেখা আর দশজনের মতো নয়। তারা শুধু চর্ম চোখে সাদামাটা দর্শন করেন না, তাদের দেখা ব্যতিক্রম বলেই তারা হয়ে ওঠেন দার্শনিক। এপিজে আবদুল কালামের একটি বিখ্যাত উক্তি ‘যে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে সেটা আসল স্বপ্ন নয়, বরং যে স্বপ্ন তাকে ঘুমাতে দেয় না সেটাই প্রকৃত স্বপ্ন।’ এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল। ভারতের জাতির পিতা মোহন লাল করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। এরা সবাই স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ তৈরি করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তাদের সঙ্গে কতটা মিল আছে ইতিহাস তা সুস্পষ্টভাবে পৃথক করে দেখিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিছক স্বপ্নচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি সারাজীবন লড়াই করে গেছেন। স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছিলেন তা একজন সুদূরপ্রসারী দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন প্রকৃত দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব। বাংলার স্বাধীনতার যে স্বপ্ন তিনি বুকে লালন করতেন তা বাস্তবে রূপ দিতে যে পরিকল্পনার দরকার তা তিনি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নিতে দ্বিধা করেননি, ভুলও করেননি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে তরুণ শিক্ষিত ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেন ‘ছাত্রলীগ’। পরের বছর সৃষ্টি করেন রাজনৈতিক দল প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগ। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে বাঙালী জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটে। ১৯৫৪’র নির্বাচনে প্রবীণ নেতাদের পাশে তারুণ্যের তেজোদীপ্ত যুগান্তকারী নেতৃত্বের গুণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অসম মহিমায় তাঁর নিজের স্থান এবং নিজস্ব বলয় সৃষ্টিতে সফল হন। ’৫৮-তে বাঙালী বিদ্বেষী স্বঘোষিত লৌহমানব, সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের অপশাসন, শোষণ-অত্যাচার স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অন্তরের চক্ষুকে খুলে দেয়। ’৬২’র ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন, মেধাবী ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠন করেন ‘নিউক্লিয়াস’। এজন্য যে সেদিন সবাই তাঁকে বাহবা দিয়েছিল তা কিন্তু মোটেও নয়। বরং বহু প্রগতিশীল, বামপন্থী বিপ্লবী বন্ধুরা এটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের সূচনা বলে নিন্দা-মন্দ বলতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু নিয়তির কি অমোঘ বিধান এ নিউক্লিয়াসের ধারাবাহিকতাই মহান মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার লড়াইয়ে বিশেষ অবদান রাখে। ১৯৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধের সময় অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের অসহায়ত্ব দেখে তিনি শিউরে উঠেছিলেন। সেদিনের সে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে দেশের পূর্বাংশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্বাতন্ত্র্য রক্ষাকবচ হিসেবে প্যারা মিলিশিয়া গঠনের দাবিসহ বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। লাহোরে ঘোষিত ৬ দফা তখন বঙ্গবন্ধুর নিজের দল আওয়ামী লীগও গ্রহণ করেনি। গ্রহণ করেছিল ছাত্রলীগ। ৬ দফাকে এদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসহ প্রায় সবাই বিচ্ছিন্নতাবাদের দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করে তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কেউ দমাতে, নিরস্ত, এমনকি হতাশও করতে পারেনি। ’৬৬’র ৬ দফার কারণে দিশেহারা স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সৃষ্টি করে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শত অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন উপেক্ষা করে আপন অভীষ্ট লক্ষ্যে হিমালয়ের মতো অবিচল হয়ে রইলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখে দেশবাসী নিজেদের মনের কথা শুনতে পেয়ে সমগ্র জনতা তাঁর পেছনে এসে দাঁড়াল। জনতার রুদ্র রোষে তাসের ঘরের ন্যায় ভেঙ্গে পড়ল স্বৈরাচারের অহমিকার দুর্গ। মুজিব আর শেখ মুজিব রইলেন না, হয়ে গেলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। ’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল। লৌহমানব আইয়ুবের পতন হলো। ’৭০-এ নির্বাচন দিল ইয়াহিয়া সরকার। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক বলে দাবিদার বহু রাজনৈতিক দল ‘শর্ত সাপেক্ষ’ নির্বাচনের বিরোধিতা করল। বামপন্থী অনেকেই স্লোগান তুলল ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। আবার অতি প্রগতিশীলরা ধুয়া তুলল ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে নির্বাচনে গিয়ে প্রমাণ করে দিলেন জনগণ কি চায়, তাদের নেতা কে? শোষকগোষ্ঠীর টনক নড়ল। তিনি এখানে সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচন করে প্রমাণ করলেন আব্রাহাম লিংকনের চেয়ে তিনি গণতন্ত্রের কম পূজারী নন। এরা এদের পরিণতি সম্পর্কে যা বোঝার বুঝে ফেললেন। শুধু বুঝতে দেরি হলো অথবা জেগে ঘুমানোর মতো বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতে গিয়ে এরা যে দেশের মানুষের বিপক্ষে চলে গেলেন তখন তাদের আপসোস করা ছাড়া আর কোন গতি রইল না। অবস্থা বেগতিক দেখে কেউ কেউ ৬ দফা বাদ দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার ১ দফা ঘোষণা করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চাপ দিতে কার্পণ্য করেননি। জাতির পিতা দক্ষ নাবিকের মতো তাঁর পথ চলা শুরু করেন। অনেকেই ভেবেছিলেন, আশা করেছিলেন, এমনকি অতি উৎসাহীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন ৭ মার্চ রেসকোর্সে ১০ লাখ জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু যেন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামান্য ভুলও করতেন তবে বাংলার স্বাধীনতা হতো না। বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ নিয়ে লাখ লাখ জনতাসহ সেদিন তাঁকে জীবন দিতে হতো। চলবে...
×