ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বাংলার চিরন্তন মুজিব

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৮ আগস্ট ২০১৮

বাংলার চিরন্তন মুজিব

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের কথা। পৃথিবীর বহু দেশ তখনও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। ইংরেজদের দখলে ভারতবর্ষ। প্রথম বিশ^যুদ্ধ থেমে গেছে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। ভারতবর্ষের অজানা ও নিভৃত প্রত্যন্ত গ্রাম নাম টুঙ্গিপাড়া যে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মধুমতি নদী। প্রত্যন্ত এই গ্রামে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, একসময় সে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, তার নাম ও যশ ছড়িয়ে পড়বে দূর-দূরান্তেÍ এতটুকু স্বপ্ন হয়ত বা তার গর্বিত পিতা-মাতার ছিল। অজানা আশঙ্কা থাকাও অসম্ভব ছিল না। পরাধীন দেশে মানুষের স্বপ্ন কতটুকুই বা পূর্ণতা পায়। আর দূর-দূরান্তে যশ ছড়িয়ে পড়া! সে কত দূরকে বোঝাবে? আজ থেকে ৯৮ বছর আগে ১৯২০ সালের এই অঞ্চলে যখন ঢাকা শহর থেকে দূরের এমন অনেক গ্রাম আছে, যেখানে যেতেই দুই-তিন দিনের মতো সময় লেগে যেত, তখন এই সীমানার মধ্যে বড় হওয়াটা স্বপ্নেরও অতীত। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে যে ফুটফুটে ছেলের জন্ম হয়েছিল পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালীর ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম পুত্র সন্তান, বাবা-মায়ের অনাবিল আনন্দ, শেখ পরিবারের নতুন অতিথি সবাই আদর করে নাম রেখেছিলেন খোকা। ১৯২৭ সালে খোকা গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন যখন তার বয়স সাত বছর। ১৯২৯ সালে নয় বছর বয়সে খোকা গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। চোখে জটিল রোগের সার্জারির কারণে ১৯৩৪ থেকে চার বছর তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি। ১৯৪১ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ম্যাট্রিক পাসের পর মুজিব কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন। ভারত ভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। তবে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। কারণ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে তাঁকে ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্কুল জীবন থেকেই মুজিবের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশ ঘটেছিল। তিনি যখন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলের ছাত্র সে সময় ১৯৩৯ সালে একবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হক ওই স্কুল পরিদর্শনে আসেন। ওই অঞ্চলের অনুন্নত অবস্থার প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কিশোর মুজিব বিক্ষোভ সংগঠিত করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এইচ. এস সোহ্রাওয়ার্দীর একজন একনিষ্ঠ অনুসারী। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে ফরিদপুর জেলায় দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে প্রধান সংগঠকদের একজন ছিলেন শেখ মুজিব। বস্তুত জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদকের তিনটি পদের মধ্যে একটিতে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। পঞ্চাশের দশক তার রাজনৈতিক উত্থানের কাল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন দূরদর্শী এক রাজনৈতিক নেতা। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন এবং হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে গঠন করেন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। তিনি দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী এবং ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা থেকে নয় মাস পর ইস্তফা দেন। ১৯৬৪ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের শাসনামলে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার মতো সাহসিকতা দেখিয়েছেন শেখ মুজিব, পাকিস্তান ধারণাটির বিষয়ে ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর মোহমুক্তি ঘটেছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মনোভাবের মধ্যে সমতা ও সৌভ্রাতৃত্ব বোধ ছিল না। ১৯৬৬ সালেই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, আইয়ুব সরকার দেশে আসন্ন একটি গৃহযুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টায় মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়। শেখ মুজিব ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করেন। মুক্তির পরবর্তী দিন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রমনা রেসকোর্সে তাঁর সম্মানে গণসংবর্ধনার আয়োজন করে। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স মাঠে পূর্বঘোষিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল সমাবেশে। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, প্রত্যেকের ঘরে, ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×