ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভূমিকম্প ঝুঁকি ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ৬ এপ্রিল ২০১৮

ভূমিকম্প ঝুঁকি ও  বাংলাদেশের প্রস্তুতি

ভূমিকম্প হলো (ঊধৎঃযয়ঁধশব) ভূ-পৃষ্ঠে সংঘটিত আকস্মিক ও অস্থায়ী কম্পন। ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলারাশিতে সঞ্চিত শক্তির আকস্মিক অবমুক্তির কারণে সৃষ্ট এই স্পন্দনের মাত্রা মৃদু কম্পন থেকে প্রচন্ড ঘূর্ণনের মধ্যে হতে পারে। ভূমিকম্প হচ্ছে তরঙ্গ গতির এক ধরনের শক্তি- যা সীমিত পরিসরে উদ্ভূত হয়ে ঘটনার উৎস থেকে সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয় ভূমিকম্প। ভূমিকম্প পরিমাপের সবচেয়ে প্রচলিত মাপক হচ্ছে রিখটারের মান। রিকটার স্কেলে তীব্রতা নির্ধারণে সিসমোগ্রামে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠ তরঙ্গ বিস্তার (Surface Wave Amplitude) এবং প্রাথমিক (P) ও মাধ্যমিক (S) তরঙ্গ পৌঁছানোর সময়ের পার্থক্যকে ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে ভূমিকম্পের বণ্টন বৈষম্যমূলক। অবশ্য প্রায় সকল ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প দুটি সুপরিচিত অঞ্চল বা বলয়ে উদ্ভূত হতে দেখা যায়। অঞ্চল দুটি হলো দি সারকাম-প্যাসিফিক বেল্ট বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় বলয় এবং ভূমধ্যসাগরীয় হিমালয় ভূকম্পনীয় বলয়। ভূমিকম্প কেন হয়? আমাদের ভূপৃষ্ঠকে মোটামুটিভাবে ৭-৮ প্লেটে ভাগ করা যায়। এই প্লেটগুলোর পুরুত্ব ১০০ কি.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা পৃথিবীর অভ্যন্তরের উত্তপ্ত তরলের উপরে ভেসে আছে এবং প্রতি বছরে ০-১০০ মি.মি. হারে সব সময়ই পা টিপেটিপে হাঁটছে। এদের এই নড়াচড়ার কারণে একটি প্লেটের সঙ্গে আরেকটি প্লেটের সংঘর্ষ হয় এবং এর ফলে আমরা কম্পন অনুভব করি। এ ধরনের ঘর্ষণজনিত কম্পন সারা বছরই ঘটে। মৃদু কম্পনগুলো আমরা অনুভব করতে পারি না। কম্পনের মাত্রা যখন বড় হয় তখনই আমরা বুঝি যে ভূমিকম্প ঘটেছে। বিভিন্ন সূত্রমতে জানা যায়, ২-৩ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে বছরে এক লাখেরও বেশি, আর বড় ধরনের ভূমিকম্প অর্থাৎ ৬.০ মাত্রার অধিক ভূমিকম্প ঘটে বছরে এক শ’র কিছু বেশি বার। বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন যে কোন সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানবে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আর্থ অবজারভেটরি। ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা চলছে। গবেষণায় দেখা যায় যে, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশের দুই দিকের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। একটা হচ্ছে উত্তরপূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টে, আরেকটা হচ্ছে চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টের পাহাড়ী অঞ্চলে। আসলে দুইটা বড় ধরনের ভূমিকম্প আমাদের বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। উত্তর প্রান্তে যেটা ডাউকি ফল্ট এখানে সঙ্কোচনের হার হচ্ছে প্রতি এক শ’ বছরে এক মিটার। গত ৫শ’ থেকে ৬শ’ বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোন রেকর্ড নেই। তার মানে ৫-৬ মিটার চু্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে ডাউকি ফল্ট ও চিটাগাং ত্রিপুরা বেল্টের পাহাড়ী অঞ্চলে। এটা যদি রিখটার স্কেলে প্রকাশ করা হয় তাহলে দেখা যায় ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। ঢাকার মধ্যে বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থা না থাকলেও সিলেট এবং চট্টগ্রামে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকা। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঢাকা মহানগরীতে বড় ভূমিকম্প ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর লক্ষণ হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে। প্রশ্ন হলো ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? রানা প্লাজা ধসের পরই আমাদের সক্ষমতা কতটুকু তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। অথচ ভূমিকম্প পরবর্তী প্রস্তুতি খুবই জরুরী। সমসাময়িক যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, এগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমার, নেপাল এবং চীনে। এ সময় ৭.৪ এবং ৭.৯ মাত্রায়ও ভূমিকম্প হয়েছে। এ সময়ে ছোট এবং মাঝারি কয়েক দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। মাত্রা হিসাবে নেপাল, চীন এবং ভারতের প্রায় অর্ধেক মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয় বাংলাদেশে। নেপালের সমমাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভবন ধসে এবং হেলে পড়ার আশঙ্কা করেন বিশেষজ্ঞরা। যেখানে তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ। সারাদেশে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এক রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধারে দীর্ঘ সময় লেগেছে। আরও উচ্চমাত্রায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতার কী হাল হবে তা সহজেই আঁচ করা যায়। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ? ভূমিকম্পের ভয়ে আতঙ্কিত না হয়ে এ দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। ভূমিকম্প মোকাবেলায় ভূমিকম্প সহনীয় নিরাপদ অবকাঠামো তৈরি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করছে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ। ঢাকা শহরের সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে চার লাখের বেশি ভবন। রাজউক এলাকায় ১২ লাখেরও বেশি যার অধিকাংশই ভূমিকম্প সহনীয় নয়। দুর্যোগটা শুধু ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে নয়। ঢাকার অবকাঠামো যেমন দুর্বল তেমনি জনসচেতনতা কম। সেজন্য যদি একটা বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয় আমাদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হবে। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের পর নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গাও নেই ঢাকা শহরে। ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত উন্মুক্ত জায়গা দরকার। ইভাকুয়েশন স্পেস যদি আগে থেকে ক্রিয়েট করা না থাকে তাহলে ইভাকুয়েশন প্ল্যানটাই কোন কাজে আসবে না। সিডিএমপি যে কন্টিনজেন্সি ও ইভাকুয়েশন প্ল্যান করেছে সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন উন্মুক্ত জায়গার। সেটার জন্য এখনই সরকারী খাস জমি উন্মুক্ত করে ইভাকুয়েশন স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা জরুরী। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুইটি। প্রথমত, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা এবং দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়া। বাংলাদেশ একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে। বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবাণীর পর আর চুপ করে থাকা যায় না। এ অবস্থায় কখন যে ভূমিকম্প আঘাত হানে; কখন যে কে তার শিকার হয়, অজানা এ ভয়ে সবাই আতঙ্কিত। একেকটা ভূমিকম্পের পর আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। আর এ ভয় যেন জয় করার কোন উপায় নেই। এ আতঙ্ক গোটা দেশবাসীকে পেয়ে বসেছে। ভূমিকম্প কোথায় হবে? কখন হবে এবং তা কত মাত্রায় হবে, তা আগবাড়িয়ে কেউ বলতে পারেন না। ভূমিকম্পের বিষয়টি সম্পূর্ণই অনুমেয়। তবে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার কিছু পূর্বলক্ষণ আছে। যা বাংলাদেশে বেশ লক্ষণীয়। এর লক্ষণ হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে। বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল হলেও এই কম্পনের প্রকৃতি ও মাত্রা সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা খুবই অপ্রতুল। আবহাওয়া দফতর ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে একটি ভূকম্পন মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে। আজও সেটিই দেশের একমাত্র ভূকম্পন মানমন্দির। বিশেষজ্ঞের মতে, কেবল ভূমিকম্পই নয় দেশের উপকূলীয় এলাকা ঘিরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজমান রয়েছে। এ গ্যাপ থেকে যে কোন সময় সুনামিও হতে পারে। তাদের মতে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোন বরাবর ৬শ’ কিলোমিটারের একটি সাইসমিক গ্যাপ রয়েছে। আমাদের দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি এই সাইসমিক গ্যাপে জমা হয়ে আছে। এই গ্যাপ আমাদের জন্য অশনিসঙ্কেত। এখান থেকে ৮ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা যদি সাগরতলে হয় তাহলে সেই ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞের মতে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আমাদের দেশে সুনামি ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। ভূমিকম্প ছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম খবর অনুযায়ী জানমাল রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্পের বেলায় সে সুযোগ নেই। ভূমিকম্প ঘটে হঠাৎ করে। ফলে জানমাল রক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তা হলে কি ভূমিকম্পে শুধুই অকাতরে প্রাণ দিতে হবে? জীবন রক্ষার কি কোন উপায় নেই। এ দুর্যোগে কি কোনই সুযোগ নেই পূর্ব প্রস্তুতির? নিশ্চয়ই আছে। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া অধিক জরুরী। তাই ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। জাতিসংঘের তৈরি ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগের তালিকায় ঢাকা এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। এক পরিসংখানে দেখা গেছে, সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল রাজধানী ঢাকার প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার অবকাঠামোর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন ধসে যাবে। এতে অসংখ্য লোকের প্রাণহানি হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় রয়েছে। প্রথমত. ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা এবং দ্বিতীয়ত. ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়া। দীর্ঘদিন যাবত ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির কথা বলা হলেও উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থা এখনও খুবই শোচনীয়। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিম্নতম পর্যায়ে রাখতে হলে বাড়িঘর ও হাসপাতালসহ সরকারী-বেসরকারী ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত। অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য। বাংলাদেশকে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য ও নিরাপদ রাখতে চাইলে আর বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই। বন্যা ও সাইক্লোন দুর্যোগের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও প্রশংসিত। সুদীর্ঘ সময় ধরে বড় ধরনের কোন ভূমিকম্প হানা না দেয়ার কারণে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতা সীমিত। তবে ইতোমধ্যে দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে এডহকভিত্তিক বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন এ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২-এর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা সম্ভব। লেখক : গবেষক [email protected]
×