ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

তোফায়েল আহমেদ

মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিকথা

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৭ এপ্রিল ২০১৭

মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিকথা

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে আজ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর কত কথা আমার মানসপটে ভেসে উঠছে। ’৭১-এর ২৫ মার্চ দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির জনকের কাছ থেকে বিদায় নেই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘ভাল থেক। আমার দেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন কর।’ ২৫ মার্চ রাতে মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে আমরা অবস্থান করি। রাত ১২টায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচ- গোলাগুলি। এক রাতেই পাকবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি জাতির জনককে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরও আগেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি। দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিশ্ড।’ তারপর ২৬ তারিখ থেকে কার্ফু জারি হয়। ২৭ তারিখ ২ ঘণ্টার জন্য কার্ফু শিথিল হলে আমরা কেরানীগঞ্জ চলে যাই। কেরানীগঞ্জ পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওতে শুনতে পেলাম চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নানের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ তথা ‘উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব’-এর কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ কেরানীগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমিসহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো যে, মণি ভাই ও আমি, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নিয়ে আমরা ভারতের দিকে যাব। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। মনে পড়ে, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ভুট্টো যখন টালবাহানা শুরু করে তখন সকলের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল যে, পাকিস্তানীরা বাঙালীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বঙ্গবন্ধু এটা উপলব্ধি করেছিলেন আরও আগেই। বলতে গেলে নির্বাচনের পরপরই তিনি বুঝেছিলেন ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং তিনিও চান নাই ক্ষমতা হস্তান্তর করুক। সেজন্যই ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে) ১০ লক্ষাধিক সংগ্রামী মানুষের মহাসমাবেশে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ করিয়েছিলেন এবং ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচিত হবে সেই ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ৬ দফা প্রশ্নে তিনি কোন আপোস করবেন না। ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানম-ির ৩২ নম্বরে জাতির জনক জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বলেছিলেন, ‘এখানে থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি।’ ২৯ মার্চ কেরানীগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে এপ্রিলের ৪ তারিখ আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেনÑ পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী- জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। এপ্রিলের ১০ তারিখ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব.’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬ নম্বর প্যারায় লেখা আছে ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন’ এবং ১০ নম্বর প্যারায় লেখা আছে ‘আমরা বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরও যা ঘোষিত হয় তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’ রাষ্ট্রপতি শাসিত এই ব্যবস্থায় ‘ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’, ‘একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন মনে করিলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের’ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করার বিধান রাখা হয়। এছাড়া যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, সেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই মর্মে বিধান রাখা হয় যে, ‘কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।’ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী. জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও খোন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদান করেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন সেইদিন থেকে কার্যকর হয়। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে বলতে হয়, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধান। এই সংবিধান মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে। তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুঁড়ি পৌঁছাই, তখন ওখানে পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোসহীন, এককাতারে দ-ায়মান। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল যেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয় তার আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি-আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান একটা গাড়িতে করে রাত ৩টায় নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে রওনা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আম্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশী-বিদেশী অনেক সাংবাদিক ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান বাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে। মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব। সেদিনটি ছিল শনিবার। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা গগনবিদারী স্বরে ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনি দিল। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠানস্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহণ করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকগণ পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেতৃবৃন্দকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সরকারের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএর (গবসনবৎ ড়ভ ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু) উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে অংশ বিশেষ পাঠ করা হয়। আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা মায়ের চারজন বীর সন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ উপস্থিত সকলেই তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলালাম। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজীতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তাঁর পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তঁাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট-বড় জাতির বন্ধুত্ব।’ ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয় বাংলা।’ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই তাঁরা বলেছেন। আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকসহ অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখে, রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। পরে ৩০ লক্ষাধিক মানুষের রক্ত¯œাত আত্মদান ও ২ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সার্বিক সাফল্য নিশ্চিত হয়েছিল এই দিনটিতেই। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম। আজ দেশের সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করে। গত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ জাতীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সেদিন জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যত অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আরও উন্নত হচ্ছে। কোন অপশক্তির কাছে আমরা মাথা নত করব না।’ অথচ বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করেননি। তিনি ‘গণহত্যা দিবস’ স্বীকার করেন না। আমি মনে করি, যারা ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করেন না তারা ঘৃণিত এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদী মৃত্যুকে বরণ করেছেন তাদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দুঃসময়ে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। মিত্রবাহিনী গঠন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সৈনিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছে। দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনকের অনুরোধে স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ’৭২-এর ১২ মার্চ তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ ভারতের সুমহান আত্মত্যাগকে তাচ্ছিল্য করে আজও যারা ‘দেশ বিক্রির’ কথা বলে-বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সঠিকভাবেই তাদের চিহ্নিত করেন ‘অর্বাচীন’ হিসেবে। ২০১৭-এর ১৭ এপ্রিল ৪৭তম মুজিবনগর দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক বাংলাদেশকে স্বাধীন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে গেছেন সেই পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলে দেশের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত হবে। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
×