ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : পল ক্রুগম্যান;###;অনুবাদ : এনামুল হক

ট্রাম্পের পপুলিজম আসল না নকল

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

ট্রাম্পের পপুলিজম আসল না নকল

জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন কর্তৃত্ববাদীরা পাশ্চাত্য বিশ্বজুড়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে তারা সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং অচিরেই আমেরিকায় ক্ষমতা গ্রহণ করবে। আর ওপার সীমান্তেও তারা সংগঠিত হচ্ছে : অস্ট্রিয়ায় সাবেক নাৎসিদের গঠিত ফ্রিডম পার্টি রাশিয়ার শাসক দলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনীত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে দেখাসাক্ষাত করেছে। কিন্তু এই দলগুলোকে আমাদের কি নামে অভিহিত করা উচিত? অনেক রিপোর্টার ‘পপুলিস্ট’ শব্দটা ব্যবহার করছেন যা একই সঙ্গে অনুপযুক্ত ও ভ্রান্তিপূর্ণ। আমার ধারণা বর্ণবাদকে এই অর্থে পপুলিস্ট বলে গণ্য করা যেতে পারে যে এর মধ্য দিয়ে এলিটবহির্ভূত কিছু জনগোষ্ঠীর মতামত প্রতিফলিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই আন্দোলনের অন্যান্য অভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন ষড়যন্ত্র তত্ত্বে¡র প্রতি আসক্তি, আইনের শাসনের প্রতি ঔদাসীন্য এবং সমালোচকদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা- এগুলো কি সত্যি ‘পপুলিস্ট’ তকমা ধারণ করতে পেরেছে? অথচ তারপরও এই উদীয়মান জোটের- অশুভ শক্তির এই চক্রটির সদস্যরা শ্রমিকদের সত্যিকারের কিছু কল্যাণ এনে দিয়েছে। হাঙ্গেরির ফাইদেসজ পার্টি মর্টগেজ সুবিধা দিয়েছে এবং ইউটিলিটির দাম কমিয়ে এনেছে। পোল্যান্ডের ল’ এ্যান্ড জাস্টিস পার্টি শিশুকল্যাণ সুবিধা বাড়িয়েছে, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করেছে এবং অবসরের বয়স কমিয়েছে। ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট সে দেশের ব্যাপক বিস্তৃত কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থার রক্ষক হিসেবে দাঁড়িয়েছে- তবে সেই কল্যাণমূলক ব্যবস্থাটি কেবল সঠিক লোকদের জন্য। ট্রাম্পবাদ অবশ্য ভিন্ন জিনিস। নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি যেসব বাগাড়ম্বর করেছিলেন তার মধ্যে চিকিৎসা সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা অক্ষুণœ রাখার এবং ওবামা কেয়ারের পরিবর্তে ‘দারুণ’ কিছু চালু করার প্রতিশ্রুতি হয়ত ছিল। তবে তার নীতিনির্ধারণী যে সব বিষয় দেখা দিতে শুরু করেছে তা আর যাই হোক না কেন পপুলিস্ট নয়। যাবতীয় যেসব আলামত দেখাত পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে মনে হয় বিলিয়নিয়ারদের অপ্রত্যাশিতভাবে বিশাল প্রাপ্তিযোগ ঘটবে এবং সেই সঙ্গে এমন সব কর্মসূচী ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করা হবে যেগুলো শুধু গরিবদের নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণীরও স্বার্থের সহায়ক। আর ট্রাম্পের ৪৬ শতাংশ ভোট শেয়ারের সিংহভাগ যারা সেই শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণীরই সবচেয়ে বড় লোকসান ঘটতে যাচ্ছে। ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণী প্রস্তাবনাগুলো আমরা এখনও অবধি পাইনি সত্য। তবে ট্রাম্প মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে যাদের বেছে নিচ্ছেন তা দেখে বোঝা যায় বাতাস কোন্ দিকে বইছে। বাজেট ডিরেক্টর এবং স্বাস্থ্য ও মানবসেবা প্রধান হিসেবে যে দুজনকে তিনি বেছে নিয়েছেন তারা দুজনেই আয়ত্তসাধ্য স্বাস্থ্য পরিচর্যা আইন বাতিল করতে ও মেডিকেয়ার ব্যবস্থা ব্যক্তিমালিকানায় দিতে চান। শ্রমমন্ত্রী হিসেবে তিনি যাকে মনোনীত করেছেন তিনি ফাস্টফুডের একজন টাইকুন। ইনি ওবামা কেয়ার ও ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি উভয়ের ঘোরতর বিরোধী। আর প্রতিনিধি পরিষদ ইতোমধ্যে অবসরের বয়স বহুলাংশে বাড়িয়ে তোলাসহ সামাজিক নিরাপত্তায় আমূল কাটাছাটের পরিকল্পনা পেশ করেছে। এসব নীতির ফলে কি দাঁড়াবে? যে সব অঞ্চল ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে ওবামা কেয়ারের বদৌলতে সে সব অঞ্চলে এ বছর স্বাস্থ্য বীমা না করা লোকের সংখ্যা বড় আকারে হ্রাস পেয়েছে। আর ওবামা কেয়ার বাতিল করার অর্থ হলো সেই সব সুফল নস্যাত করে দেয়া। নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান আরবান ইনস্টিটিউটের হিসেবে ওবামা কেয়ার বাতিল করলে ৩ কোটি আমেরিকান স্বাস্থ্য খাতে প্রাপ্ত সরকারী সুবিধা হারাবে। আর এই ৩ কোটির মধ্যে ১ কোটি ৬০ লাখই হলো অহিসপানিক শ্বেতাঙ্গ। এবং না, ওবামা কেয়ারের বদলে দারুণ কিছু আসবে না। রিপাবলিকান পরিকল্পনায় আইন বলে যত লোককে স্বাস্থ্য সুবিধাবঞ্চিত করা হবে তার অতি সামান্য অংশ এই সুবিধার আওতায় আসবে। আর যারা আসবে তারা বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ, অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান ও অপেক্ষাকৃত ধনী। মেডিকেয়ারকে ভাউচার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করা হলে স্বাস্থ্য সুবিধা দারুণ হ্রাস পাবে। সেটা অংশত এই কারণে যে এই খাতে ব্যয়ের এটা উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাবে প্রাইভেট বীমা কোম্পানিগুলোর উপরি ব্যয় ও মুনাফা হিসেবে আর সামাজিক নিরাপত্তা লাভের জন্য অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানো হলে সেই সব আমেরিকান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অচলাবস্থায় আছে কিংবা হ্রাস পেয়েছে অথবা যাদের শারীরিক অক্ষমতা এমন যে কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে রীতিমতো কঠিন এই সমস্যাগুলো ট্রাম্পের ভোটের সঙ্গে প্রবলভাবে সম্পর্কযুক্ত। অন্য কথায়, যে আন্দোলন এখানে এই আমেরিকায় আজ ক্ষমতা গ্রহণ করতে উদ্যত সেটা ইউরোপের চরম দক্ষিণপন্থী আন্দোলনের মতো ঠিক এক জিনিস নয়। ওদের বর্ণবাদ এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাচ্ছিল্যভাবের সঙ্গে এই আন্দোলনের মিল থাকতে পারে তবে ইউরোপীয় পপুলিজম অন্তত আংশিকভাবে হলেও আসল বা খাঁটি। অন্যদিকে ট্রাম্পের পপুলিজম শ্রমিক শ্রেণীর ভোটারদের কাছে ফিরি করা পুরোটাই নকল ও জালিয়াতি-জোচ্চুরির ব্যাপার বলে প্রতিভাত হয়ে উঠছে এবং সেটা এই ভোটাররা অতি রূঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে উদ্যত হয়েছে। নতুন সরকার কি এর রাজনৈতিক মূল্য দেবে? যাই হোক এর ওপর নির্ভর করতে যাবেন না। সস্তায় ভাল জিনিস দেয়ার নামে বেশি দামে বাজে জিনিস গছিয়ে দেয়ার এই বিশাল ধাক্কা সমর্থকদের প্রতি এই বিশ্বাসঘাতকতা ডেমোক্র্যাটদের কাছে নিশ্চয়ই এক রাজনৈতিক সুযোগ হিসেবে উপস্থিত হবে। কিন্তু আপনারা জানেন যে পরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর দারুণ চেষ্টা চলবে। তার মধ্যে এমন কথাও বলা হবে যে স্বাস্থ্য পরিচর্যা ধসে পড়ার ব্যাপারটা সত্যিকার অর্থে প্রেসিডেন্ট ওবামারই ত্রুটি। বলা হবে যে বিকল্প উপায়গুলোর ব্যর্থতা কোন না কোনভাবে অবাধ্য, দুর্বিনীত ডেমোক্র্যাটদের ভুলভ্রান্তির ফল। আর সেই সঙ্গে জনগণকে বিভ্রান্ত করার একের পর এক সীমাহীন চেষ্টা চলতে থাকবে। ক্যারিয়ার স্টাইলের আরও অনেক চমক আশা করতে পারেন যা শ্রমিকদের সাহায্য করবে না অথচ সংবাদ মহলে প্রাধান্য পাবে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আরও অনেক বিষোদ্গার আশা করতে পারেন। আর কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো বরাবর যা করে সে কথা মনে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো ব্যর্থ নীতি থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়া- যেমন মোকাবেলা করার জন্য কিছু বিদেশীকে খুঁজে বের করা। সেটা হতে পারে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ, হতে পারে তার চেয়েও খারাপ কিছু। বিরোধীদের প্রয়োজন জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এই কৌশলগুলো ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য যা করতে পারা যায় তার সবকিছুই করা। সর্বোপরি এমন কোন সহযোগিতার মধ্যে তাদের যেন টেনে আনতে না পারা যায় যাতে করে খানিকটা দোষ তাদের ঘাড়েও এসে বর্তায়। এই ধাপ্পাবাজি যারা করছেন তাদের দায়-দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা উচিত। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×