ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দীপিকা ঘোষ

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনায় বিকাশের স্তর

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৫ আগস্ট ২০১৬

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনায় বিকাশের স্তর

জীবনের মতো মরণকেও রবীন্দ্রনাথ উদ্ঘাটন করেছেন বিচিত্র স্বরূপের নতুন নতুন পর্যায় অতিক্রম করে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের স্বজনহারানোর বেদনা অন্তরের অনাবৃত স্পর্শে শোকের আবর্তে যখন আবর্তিত হয়েছে, তখন তাতে কখনো কখনো কোলরিজ কিংবা লর্ড বাইরনের জীবনমুখীন বাস্তবতা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। জীবনের সুধাপাত্র নিঃশেষ করে রিক্ততার অপার বেদনায় মৃত্যু সেখানে ধরা দিয়েছে নিষ্ঠুর নির্লিপ্তির বৈরাগ্যের চিহ্ন বয়ে। আবার সেই একই মরণ, বেদনার অনিবার নিঃসরণ সত্ত্বেও কবি কীটসের সৌন্দর্যের রসসম্ভারে ভেসে, শেলীর রহস্যময়তার অনিঃশেষ বিমূর্ততায় হয়ে উঠেছে নতুন জীবনের অনুপ্রেরণা। কখনো ওয়ার্ডসোয়ার্থের বৈশিষ্ট্যের মতো প্রকৃতির পরিশুদ্ধতার সারল্য মেখে, মৃত্যু হয়ে উঠেছে আত্মার প্রণয়ী। কখনো বা ব্রাউনিংয়ের জীবন গভীরতার দার্শনিক বিশ্লেষণী সুরে মৃত্যুর বাস্তবতা ভিন্ন ভিন্ন পারিপার্শ্বিকতায় খুঁজে পেয়েছে তার বৈচিত্র্যের সন্ধান। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও সবার ওপরে রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ‘মৃত্যু’ জীবনেরই আরেক নাম। জন্মজন্মান্তর অনন্ত জীবনের যাত্রাপথে পরমাত্মীয়ের মতো নতুন নতুন জীবনপথের অনুসন্ধানদাতা সে। কখনো সে মহাকালের মহামিলনদূত। কবির মানসসরোবরে উপলব্ধির বর্ণচ্ছটায় যার নিগূঢ় সত্তা রহস্যময়তার আবরণ পরে, চাক্ষুষ বাস্তবতা অতিক্রম করে, বিশেষকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে নির্বিশেষ। আবার পরক্ষণেই নির্বিশেষ থেকে বিশেষের স্তরে নেমে ব্যক্তিসত্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, প্রণয়িনী রাধিকার শ্যামরূপে অমৃতের উৎসের মতো। আর এখানেই ওপরে উল্লেখিত পাশ্চাত্যের লেখকদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় সাধন থাকা সত্ত্বেও বিশ্বকবির মৃত্যুভাবনা তাঁর নিজস্ব চেতনায়, পৃথক দর্শনে একান্ত অন্তরঙ্গতা লাভ করেছে। এর কারণ, সূক্ষ্ম মানসিকতার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক চিত্ত জীবন জগতের বিচিত্র সৌন্দর্য এবং প্রেমের অনুভূতিতে যতই কেন না আচ্ছন্ন হয়ে উঠুক, প্রকৃতির আবেদন কবি অন্তরের একাত্মতার অনুভূতির ছোঁয়ায় অরূপের রহস্য জড়িয়ে যতই কেন না ছবির পরে ছবি এঁকে বিভিন্ন রচনায়, গানে, শিল্পে, কবিতায় দৃশ্যময় হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক, রবীন্দ্রনাথ মূলত প্রেম এবং সৌন্দর্য উপভোগের রোমান্টিক কবি হলেও একই সঙ্গে ভারতীয় সন্ন্যাসী ঋষির মতো সত্যান্বেষী দার্শনিকও। রহস্যময়তার আড়াল ছাড়িয়ে সত্যের পরমতত্ত্বে যাঁর হৃদয় বিরামহীন আকুলতায় বিচরণ করে ফিরেছে। জীবন এবং বিশ্বসৃষ্টির সুগভীর তাত্ত্বিক দর্শনকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করেও যিনি অনন্য সাধারণ শিল্পময়তায়, অতীন্দ্রিয় সত্তার প্রগাঢ় রহস্যময়তায় চিত্রায়িত করতে উন্মুখ হয়েছেন। আবার একইভাবে রহস্যের আবরণ ছিন্ন করে, শব্দ ব্যবহারের অভাবনীয় শিল্পকৌশলে সেই তত্ত্বকেই রূপায়িত করেছেন ধ্যানীর ধ্যানের অন্তর্দৃষ্টির পরশ দিয়ে। যেখানে অনির্বচনীয়ের নিরন্তর আনন্দ আর পার্থিব জীবনের বাস্তবতা, একই সঙ্গে মিলেমিশে জন্ম দিয়েছে ভিন্নতর জীবন দর্শনের। যেমন উপনিষদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা বলেছেন- ‘এই জগত সেই মৃত্যুহীন শাশ্বত সত্তার আনন্দ সম্মিলনের মহাপ্রকাশ। বিশ্বসৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষহীন বলে যা কিছু বিরাজিত আছে, তাদের সবই সেই চিরসুন্দর, চিরশুদ্ধ অমরনাথের আনন্দময় অভিব্যক্তি। বিশ্বের সকল সৌন্দর্য, পার্থিব জগতের সঞ্চিত সমস্ত সুধা তাঁর থেকে সৃষ্ট বলেই অবিনাশী। অনাদিকাল ধরে নানা রূপে বিকশিত। জীবনপ্রবাহ তাই মৃত্যুহীন। হে অমৃতের অমর সন্তান, এই পরম সত্য জ্ঞাত হয়ে অমৃততত্ত্ব লাভ করো’। রবীন্দ্রনাথও জীবনের প্রথম প্রভাতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে অমৃতের স্বরূপ বলেই আহ্বান করেছিলেন ভাণুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে ‘মরণ’ কবিতায়। বলেছিলেনÑ ‘মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।/মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,/রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট/তাপবিমোচন করুণ কোর তব/মৃত্যু অমৃত করে দান’(ভাণুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ১২৮৮)। কেননা সংকীর্ণতার প্রাচীর ভেঙে বিশ্বব্যাপ্তির সঙ্গে মিলনের আকাক্সক্ষা কৈশর থেকেই ইঙ্গিত দিয়েছিল তাঁর সমস্ত রচনা ঘিরে। ‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,/জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি’ (প্রভাত উৎসব, প্রভাতসঙ্গীত ১২৮৮)। প্রভাতসঙ্গীতের কাল থেকেই তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছে সমগ্র ভুবনের সঙ্গে নিজের জীবনের একাত্মতার আনন্দঘন অনুভূতি। এই আনন্দামৃতের অনুসন্ধান বেদান্তের দার্শনিকরা রেখে গিয়েছেন সহস্র সহস্র বছর আগে পৃথিবীর অমৃতস্য পুত্রদের জন্য। এই অমৃতলাভ হয় খ-ত্বে নয়, অখ- চেতনার উন্মেষ হলে। যখন এই উপলব্ধি জাগ্রত হয়, নিত্যগতিশীল মহাকালের সঙ্গী হয়ে মানবের জীবনস্রোতও চঞ্চলা নদীর মতো নিয়ত প্রবহমান। জীবন এই ক্রমাগত প্রবাহমানতা লাভ করে তখনই, মৃত্যুর স্পর্শ পেয়ে যখন সে পুনরুজ্জীবন লাভের আশীর্বাদে ধন্য হয়। ভাণুসিংহ মরণকে তাই প্রণয়িনী রাধিকা হয়ে সম্বোধন করে বলছেনÑ ওগো মরণ, তুমি শ্রীরাধিকার প্রণয়ী শ্যামের মতোই প্রিয়তম আমার কাছে! তুমিও শ্যামের মতোই রহস্যময়। কিন্তু তারপরেও সর্বতাপ বিমোচনকারী অনিন্দ্যসুন্দর! এখানে এই কথাটি বলে রাখা ভাল, মৃত্যুভাবনার যে বিকাশের স্তরগুলো রবীন্দ্র রচনায় ধরা পড়ে, সেটা রবীন্দ্র দর্শনের তাত্ত্বিক দিক নয়। রোমান্টিক কবি মনের, অরূপের সান্নিধ্য লাভে সৌন্দর্য আর প্রেমের রাজ্যে বিচিত্রের আস্বাদন। কবি তাই জীবনের নব নব সঙ্গীতের কুসুম ফোটাতে চেয়ে হাসি-কান্না, বিরহ মিলন ভরা ধূলির ধরণী ছেড়ে, মানুষের মাঝে পড়ে থাকার আকুলতা নিয়ে যে মহূর্তে তীব্র বিষণœতা নিয়ে বলে ওঠেন- ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’ (প্রাণ, কড়ি ও কোমল ১২৯৩), ঠিক তার পরেই দেখি উৎসর্গের ‘জন্ম ও মরণ’ কবিতায় এসে বলছেন- ‘নব নব জীবনের গন্ধ যাব রেখে,/নব নব বিকাশের বর্ণ যাব এঁকে। /কে চাহে সংকীর্ণ অন্ধ অমরতাকূপে/এক ধরাতল মাঝে শুধু এক রূপে/বাঁচিয়া থাকিতে’! (জন্ম ও মরণ, উৎসর্গ ১৩১০)। কবি বলছেন -জীবনের মধুরতম সঙ্গীত হয়ে ওঠে সেগুলোই, যারা বিষণœতম বেদনার কথা বলে। সেই বেদনার রসে তলিয়েই গভীর আনন্দে মাতাল হয়েছি আমি। আজ রাতে তাই আর অন্য মদ পান করতে চাই না। পরিশুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গলাভে ধন্য হওয়া কবি ওয়ার্ডসোয়ার্থের কবিতাতেও ধ্বনিত হয়েছে -‘এ সিম্পল চাইল্ড/দ্যাট লাইটলি ড্রস ইটস ব্রেথ/এ্যান্ড ফিলস ইটস লাইফ ইন এভরি লিম্ব্/হোয়াট শুড ইট নো অফ ডেথ’? (উই আর সেভেন)। একটি নিষ্পাপ সরল শিশু যখন তার ছোট ছোট নিঃশ্বাসের টানে দেহের প্রতি অঙ্গে-অঙ্গে জীবনের উপস্থিতি অনুভব করে, মৃত্যুর ধারণা তার থাকে কোথায়? রবীন্দ্রনাথও এই দর্শনে বিশ্বাসী যে, এই বিশ্বজগতে যা কিছু অস্তিত্বময় সবই সেই চিরপবিত্র বিশুদ্ধ নিষ্পাপ শাশ্বতের থেকে উৎপন্ন বলে মৃত্যুর বিশ্বাস আমাদের থাকা উচিত নয়। কারণ যে অসীম প্রাণপ্রবাহ অনাদিকাল ধরে বিশ্বনৃত্যের ছন্দে ছন্দে প্রবাহিত, কোন অবসান নেই তার। যাকে মৃত্যু বলে বিশ্বাস করে শোকের বেদনাবহ হয়ে ওঠে, সেটি একটি ধারণা মাত্র। প্রিয়জন যখন নয়নের সম্মুখ থেকে অপসারিত হয়, তখনো সে হারিয়ে যায় না চিরতরে- ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই/নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই,/আজি তাই/শ্যামলে শ্যামল তুমি/নীলিমায় নীল। (ছবি, বলাকা ১৩২১)। কারণ জীবনের পরিসমাপ্তি একটি সুনির্দিষ্ট দেহের মধ্যেই নয়। নব নব পরিচিতির ভেতর দিয়ে অনন্তকাল ধরে যাত্রাপথে তার পথচলা। এই যাত্রাপথ রচিত হয় বারংবার মরণের সিংহদ্বার দিয়ে। সেই আদিঅন্তহীন কাল থেকে সম্ভবত পৃথিবী সৃষ্টিরও বহু পূর্ব থেকে, যে প্রাণপ্রবাহ স্পন্দিত হয়েছিল সৃষ্টির কারণ-সমুদ্র গর্ভে, সেই প্রাণ আজও তেমনি অনিঃশেষভাবে অশেষ। রবীন্দ্রনাথ তাই ছিন্নপত্রে লিখেছেন- ‘আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে যখন তরুণী পৃথিবী সমুদ্র স্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন, তখন আমি এই পৃথিবীর নতুন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম। তখন জীবজন্তু কিছুই ছিল না, বৃহৎ সমুদ্র দিনরাত্রি দুলছে, এবং অবোধ মাতার মতো আপনার নবজাত ক্ষুদ্র ভূমিকে মাঝে মাঝে উন্মত্ত আলিঙ্গনে একেবারে আবৃত করে ফেলছে, তখন আমি এই পৃথিবীতে আমার সমস্ত সর্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম সূর্যালোক পান করেছিলুম। নবশিশুর মতো একটা অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বরতলে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিলুম। এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড়গুলো দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান করেছিলুম’। (ছিন্নপত্র, শিলাইদহ ১৮৯২)। কবি সংখ্যাহীন জন্মজন্মান্তরের কথা আজও তাই বিস্মৃত হননি- ‘মনে আজি পড়ে সেই কথা/যুগে যুগে এসেছি চলিয়া/স্খলিয়া স্খলিয়া/চুপে চুপে/রূপ হতে রূপে/প্রাণ হতে প্রাণে। (চঞ্চলা, বলাকা ১৩২১)। মরণ যদি বিনাশ সাধনই ঘনিয়ে তুলবে সবার জীবনে, তাহলে জীবন থেকে জীবনান্তরে এই যে অশেষভাবে পথ চলার সহস্র স্মৃতির আনাগোনা, সেটা কেমন করে সম্ভব? তাই বিনাশ সাধন নয়, নিরন্তর চলার জন্যই মৃত্যুর স্পর্শলাভে দেহের খোলস বদলে যায় বারংবার। কারণ এমন বদলেই সম্ভব হয়, নানা রূপ পরিগ্রহের ভেতর দিয়ে বিবিধ বৈচিত্র্যের আস্বাদন।
×