ডি.এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ খাদি সিল্ক সুতা উৎপাদনে প্রচ-ভাবে ব্যস্ত ভোলাহাট উপজেলার নারী কর্মীরা। ঈদকে সামনে রেখে এই ব্যস্ততা। কারও সঙ্গে একদ- কথা বলারও ফুরসত নেই। সমগ্র দেশ শুধু নয় গোটা বিশ্বের মধ্যে শুধু মাত্র বাংলাদেশের ভোলাহাট উপজেলায় দেশীয় পদ্ধতিতে হাতে চালিত চরকার সাহায্যে খাদি সিল্ক সুতা উৎপাদিত হয়ে থাকে। খাদি সুতার সাহায্যে পাঞ্জাবি, থ্রিপিস, শার্ট, শাড়ি, দোপাট্টা, ম্যাট্রেস কভার, বিছানার চাদর, জানালা দরজার পর্দাসহ অভিজাত ও শৌখিন বস্ত্র উৎপাদিত হয়। সেই খাদি সুতার একমাত্র উৎপাদনকারী এলাকা ভোলাহাট উপজেলা। ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই সীমান্ত উপজেলার ৪৫ মৌজার ৯১টি গ্রামের পুরোটাকে মটকা বা খাদি রেশম সুতার পল্লী বললে ভুল হবে না। রেশমের ওয়েস্টজ হতে উৎপন্ন হয় খাদি সিল্ক। রিলিং মেশিনে ফাইন সুতা উৎপাদনের অনুপযোগী রেশম গুটিই মূলত খাদির কাঁচামাল। রেশমের ওয়েস্টেজ বলতে লাট, ঝুট, কাটা ও গেঁটে রেশম গুটিকে বুঝায়। রেশমের ওয়েস্টেজ অতীতে ছিল ফেলনা বস্তু। তবে ব্রিটিশের সময়ে গ্রামীণ নারীরা টাকুর সাহায্যে যে সুতা আহরণ করত তাকে স্থানীয় ভাষায় মটক সুতা বলা হতো। দীর্ঘ সময় ধরে মটকা ও খাদি শিল্পে শুধুমাত্র নারীদের পদচারণা ছিল। ৮০ (আশি) দশকের প্রথম দিকে রেশম এই অঞ্চলে ওয়েস্টেজ হতে খাদি সুতা উৎপাদনের জন্য টাকুর পরিবর্তে হস্তচালিত চরকা চালু করে। রেশম বোর্ডকে সহযোগিতা করেছিল ব্র্যাক। প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের রেশম বীজাগার হতে কাটা গুটি ঘাই এর লট ও ঝুট সংগ্রহ করে চরকা শ্রমিকদের সরবরাহ করত। এ হতে ভোলাহাটে চরকার প্রচলন শুরু।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই অঞ্চলটি ঐতিহ্যবাহী জেলা মালদহের খুবই কাছাকাছি। আর এই কারণে ব্রিটিশ আমল হতেই নীল চাষের পাশাপাশি পুরো এলাকাটিতে রেশম চাষ করা হতো। দেশ ভাগের পর মালদহ পশ্চিম বাংলার অংশ হলেও ভোলাহাট চলে আসে বাংলাদেশের মধ্যে। তাই মালদহের ইংরেজ বাজার হতে ভোলাহাটের দূরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার। দেশের বৃহত্তম রেশম পলু উৎপাদনের এলাকা এখনও ভোলাহাট উপজেলা। প্রায় দুই শত একর জমিতে তুত চাষ করা হয়। সেরিকালচার বোর্ডের ভোলাহাট অঞ্চলের রেশম ও তুত চাষ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রুহুল আমি জানান বছরে চারটি মৌসুমে এখানে পলু পোকা চাষ করা হয়। বাংলা বছর হিসাবে তিন মাস পর পর ভোলাহাটের রেশম চাষীরা পলু পোকা চাষ করে থাকে। প্রথম মৌসুমকে বলা হয় জ্যৈষ্ঠ বন্ধ। প্রতি বন্দে প্রয়োজন পড়ে প্রায় ১৮ হাজার ডিমের। গুটি তৈরি হয় প্রায় ১১ হাজার। এখানে উল্লেখ্য, ভোলাহাট অঞ্চলে প্রায় এক হাজারের অধিক রেশম চাষী রয়েছে। তার মধ্যে পাঁচশর অধিক তুত চাষী। বাকিরা রেশম গুটি বা পোকা উৎপাদন করে থাকে। অর্থাৎ ভোলাহাটের প্রায় প্রতি ঘরেই পলু বা রেশম পোকা চাষ করে থাকে। পরবর্তীতে নানান ভাবে প্রসেজের মাধ্যমে রেশম গুটি পাওয়া যায় তা ব্যবহার হয়ে থাকে চরকা ও কাট ঘাইয়ে। এখানে চরকাতে ৪০ থেকে ৪৫ মেট্রিক টন ও কাট ঘাই হতে সুতা উৎপাদন হয়ে থাকে ৪৮ থেকে ৬০ মেট্রিক টন। এসব সুতার পুরোটা মটকা সুতা বা মোটা সুতা হিসাবে পরিচিত। একজন নারী শ্রমিক সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে কমপক্ষে ১০ লাচি সুতা উৎপাদন করতে পারে। স্থানীয়ভাবে ৩ গ্রাম খাদি সুতার বান্ডিলকে লাচি বলা হয়। ভেলাহাটে প্রতিদিন প্রায় ২ লক্ষাধিক খাদির লাচি উৎপাদন হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে বেড়ে তা আড়াই লক্ষাদিক অতিক্রম করেছে। খাদি সুতা তৈরির হস্তচালিত চরকার সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার খাদি সিল্ক সুতা ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে শুধুমাত্র ভোলাহাট উপজেলায়। এক কেজি রেশম ওয়েস্টেজের মূল্য ১৯০০ টাকা হতে ২ হাজার দুই শত টাকা। একজন নারী সপ্তাহে কমপক্ষে এক কেজি রেশম ওয়েস্টেজ কাটাই (সুতা উৎপাদন) করে কমপক্ষে সাড়ে নয় শত টাকা আয় করে।
নারী খাদি শ্রমিকদের প্রতমত, রেশমের ওয়েস্টেজ ডি-গ্যমিং (স্থানীয় ভাষায় খাড়ি করা বলে) ও ডাইং করে শুকানোর পরই সাধারণত কাটাই আরম্ভ করে। বর্তমানে খাদি সুতার চাহিদা দেশে প্রায় ১৬০ মেঃ টন। উৎপাদন হচ্ছে ১২০ মেট্রিক টন। প্রায় খাদি সুতার ওয়েস্টেজ সরবরাহ কমে গেলে স্থানীয় নারীরা বেকার হয়ে পড়ে। এবার ঈদকে সামনে রেখে ভিন্ন চিত্র। ঘাটতি ৪০ কেজি ওয়েস্টেজ কিছুটা চড়া মূল্যে চোরাকারবারিরা ভারত থেকে সরবরাহ করেছে। খাদি বস্ত্র বিদেশীদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সঙ্গে স্থানীয় শৌখিন ব্যক্তিদের। তাই বর্তমানে রাজধানীতে একাধিক রেশম খাদির প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এদের মাধ্যমে খাদি পণ্য দেশের গ-ি পেরিয়ে এখন ব্রিটেন ও আমেরিকার মতো দেশে অভিজাত বিপণিতে স্থান করে নিয়েছে রফতানির মাধ্যমে। বিদেশে অবস্থানকারী বাঙালীরা হামলে পড়ে এসব দোকানে। এবারও কিছু প্রতিষ্ঠান আগাম খাদি ও মটকা সুতার পণ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের চারটি রেশম পল্লীর তাঁত ব্যবহার করে রেশম সামগ্রী তৈরি করে বিদেশে পাঠিয়েছে ঈদবাজার ধরার জন্য। পাশাপাশি মানিকগঞ্জের কিছু খাদি প্রতিষ্ঠান, আড়ং, বাংলার মেলা রং, অঞ্জনসের মতো প্রতিষ্ঠান ভোলাহাট থেকে খাদি সুতা সংগ্রহ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের লাহারপুর, হরিনগর, শিবগঞ্জ ও বিশ্বনাথ পুরের রেশম পল্লীর মুনিপন খাদি তন্তুরায়রা তাঁতে চড়িয়ে কাপগ বুনন করে সরবরাহ করছে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
তাই এবার ঈদকে সামনে রেখে খাদি শিল্প ভোলাহাট উপজেলায় বড় ধরনের আশীর্বাদ হয়ে আত্মপ্রকাশ করল। সোনালি যুগের সূচনাও বলা চলে। সব দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা ভোলাহাট অঞ্চলের নারীরা অনেকটাই স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। চরকাচালিত আয়ে ঈদের ছোট খাট কেনা কাটা, ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি পরিশোধে স্বামী কিংবা অন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না। ভোলাহাটে প্রায় ৪০ হাজার মহিলা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে রেশম চাষ ও রেশম সুতা (মটকা ও খাদি) তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে তারা এখন মহাব্যস্ত ও ভরপুর কর্মচাঞ্চল্যে।