ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাদারীপুরে পিনাক-৬ লঞ্চ ট্রাজেডির ৭ বছর আজ

প্রকাশিত: ১৩:৫৭, ৪ আগস্ট ২০২১

মাদারীপুরে পিনাক-৬ লঞ্চ ট্রাজেডির ৭ বছর আজ

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর ॥ পিনাক-৬ লঞ্চ ট্রাজেডির ৭ বছর আজ ৪ আগস্ট। ২০১৪ সালের এই দিনে পদ্মঅয় ভয়াবহ লঞ্চ ডুবিতে সরকারি হিসেবে ৪৯ যাত্রী নিহত এবং ৫৩ জন নিখোঁজ থাকে। দীর্ঘ ৭ বছরেও বিচার হয়নি এই মর্মান্তিক ঘটনার। দূর্ঘটনায় পর ২টি মামলার আসামীরা রয়েছেন জামিনে। ৭ বছর পার হলেও দোষীদের বিচার না হওয়ায় নিহত ও নিখোঁজ স্বজনদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। লঞ্চটিতে উঠার আগে স্বর্না হিরাসহ ৩ বোনের সেলফিই এখন পরিবারের একমাত্র স্মৃতি। একই উপজেলার ফরহাদের পরিনতি আরো ভয়াবহ। ফরহাদসহ পরিবারের ৪ জনের কারো লাশ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ অর্ধ শতাধিক পরিবারের কাউকেই দেয়া হয়নি কোন ক্ষতিপুরণ। ৫৩ জনের মধ্যে আর অজ্ঞাত হিসাবে ২১ জনের লাশ দাফন করা হয় শিবচরে। ডিএনএ নমুনা রয়ে গেছে পরিচয়হীন। আজো সন্ধান মেলেনি লঞ্চটিরও। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে ঈদুল ফিতরের পর ৪ আগস্ট ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বোঝাই আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে শিবচরের কাওরাকান্দি ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া পিনাক-৬ লঞ্চটি। পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। সরকারি ভাবে ওই ঘটনায় ৪৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ থাকে ৫৩ জন। নিহতদের মধ্যে অনেকেই স্বপরিবারে ও নিখোঁজদের অনেকেই স্বপরিবারে রয়েছে। শিবচর পৌর এলাকার মোঃ নুরুল হক মিয়ার ঢাকার শিকদার মেডিকেলে ডাক্তারী পড়–য়া মেয়ে- নুসরাত জাহান হিরা ও রাজধানীর বীরশ্রেষ্ট নুর মোহাম্মদ কলেজের ছাত্রী ফাতেমাতুজ জোহরা স্বর্ণা এবং তারই ভায়রার মেয়ে চীনের জইনুস মেডিকেল কলেজের ছাত্রী গঙ্গানগর এলাকার জান্নাতুল নাঈম লাকী এই দুর্ঘটনায় ৩ জন মারা গেলেও উদ্ধার হয়েছে ২জনের মৃতদেহ। ছোট বোন ফাতেমাতুজ জোহরা স্বর্ণা এখনো নিঁখোঁজ। এছাড়া শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা গ্রামের প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধা রিজিয়া বেগমের এক ছেলে মিজানুর রহমান,পুত্রবধূ রোকসানা বেগম, আড়াই বছর বয়সের নাতি মাহিন এবং এগার বছর বয়সের নাতনি মিলিসহ একই পরিবারের ৪ জন নিখোঁজ হন। এদূঘর্টনার পরপরই মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানা ও মেরিন কোর্টে ২ টি মামলা হয়। আসামীরা গ্রেফতার হলেও বর্তমানে আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন। ৭ বছর অতিবাহিত হলেও দোষীদের বিচার না হওয়ায় নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। এ দূর্ঘটনায় উদ্ধারকৃত ৪৯ টি লাশের মধ্যে ২৮টি লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হয় আর ২১ জনকে শিবচর পৌরকবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। রেখে দেয়া হয় ওই ২১ জনের ডিএনএ টেস্টের নমুনা। তবে ৭ বছরেও কেউ শনাক্ত করতে আসেনি লাশগুলোর। মাটির নিচে গলে পচে নিঃশেষ হয়ে আছে পরিচয়টুকুও। সরকারি হিসেবেই নিখোঁজ থাকে আরো ৫৩ জন। তবে বেসরকারী হিসেবে অন্তত শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে। যে সকল পরিবারে এখনো স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোন সরকারী অনুদান। যদিও ২৮ পরিচয়ধারী নিহতদের তাৎক্ষনিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে ও পরিবর্তিতে ঘোষিত ১ লাখ ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে অনেক অসহায় পরিবারকে কাটাতে হচ্ছে মানবেতর জীবন। গত ৭ বছরেও কেউই তাদের খোঁজ নেয়নি। ঘটনার পর লৌহজং ও শিবচরে স্থাপন করা হয় অভিযোগ ও তথ্য কেন্দ্র। এ ঘটনার পরপরই নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ৭ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। নিহত হিরা ও স্বর্নার বাবা ওই লঞ্চের যাত্রী নূরুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘লঞ্চের মালিকসহ ঘাট সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে লঞ্চটি ডুবে যায়। আমার মেয়েসহ অনেক যাত্রী নিহত ও নিখোঁজ হয়। এ ঘটনার ৭ বছরেও দোষীদের কোন বিচার হলো না। গ্রেফতার হলেও তারা জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকার যদি দ্রুত দোষীদের বিচার সম্পন্ন না করে তাহলে এমন দূর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমরা এ ঘটনার দ্রুত বিচার চাই।’ বিআইডব্লিউটিএর কাঁঠালবাড়ি ঘাট পরিদর্শক আক্তার হোসেন বলেন, ‘পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবির পর এ নৌরুটে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আগে একজন পরিবহন পরিদর্শক তিনটি ঘাটের দায়িত্ব পালন করতো। পিনাক দূর্ঘটনার পরে প্রতিটি ঘাটে একজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়াসহ অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ শিবচর পৌরসভার মেয়র আওলাদ হোসেন খান বলেন, ‘অজ্ঞাত ২১ জনের লাশ পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ লাশগুলোর ডিএনএ নমুনা সংরক্ষন করা হয়েছে। পুলিশের মাধ্যমে ডিএনএ শনাক্ত করে যদি কেউ আসে তবে পরিবারের কাছে তাদের লাশ হস্তান্তর করা হবে।’ শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পিনাক ৬ লঞ্চ ডুবিতে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তবে এ দূর্ঘটনার পর থেকে এ নৌরুটে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারী রাখা হচ্ছে। এমন দূর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য লঞ্চের চালকদের জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘাট ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা হয়েছে। কোনভাবেই লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেওয়া হচ্ছে না। কেউ আইন অমান্য করলে সাথে সাথে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
×