ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সাউদিয়ার টিকেট নিয়ে হাহাকার- ক্ষোভ প্রবাসীদের

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

সাউদিয়ার টিকেট নিয়ে হাহাকার- ক্ষোভ প্রবাসীদের

আজাদ সুলায়মান ॥ সৌদি প্রবাসী নাজির মামুদ রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের সাউদিয়া এয়ারের টিকেট কাউন্টারের সামনে দু’দিন ধরে কনফার্ম টিকেট হাতে নিয়ে অবস্থান করছেন। তার ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর। এ সময়ে পৌঁছতে না পারলে চাকরি শেষ। তখন চোখের সামনে অন্ধকার অমানিশা ছাড়া আরও কিছু নেই। গত ২ মার্চ রিটার্র্ন টিকেট নিয়ে সৌদি থেকে দেশে ফেরেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার পাটুয়াভাঙ্গা বাগপাড়া গ্রামের নাজির মামুদ। সোমবার দুপুরে তিনি এখানে এসে টিকেট রিকনফার্ম করার জন্য অপেক্ষা করেন। শত চেষ্টা করেও তিনি রিটার্ন টিকেট রিইস্যু করতে পারেননি। উপরন্তু খোলা আকাশের নিচে এক রাত এক দিন চরম মানবেতর দুর্ভোগের শিকার হয়ে ক্ষোভে অভিমানে চলে গেছেন বাড়িতে। যাওয়ার সময় বলে গেছেন, আমার মতো কয়েক শত সৌদি প্রবাসী টানা দুদিন খোলা আকাশের নিচে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় অবর্ণনীয় দুর্র্ভোগের শিকার হলেও দেখার কেউ। নাজিরের মতো এমন শত শত সৌদি প্রবাসী গত তিন দিন রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের সাউদিয়া এয়ারের টিকেট কাউন্টার ও বিমানের মতিঝিল অফিসের সামনে বিক্ষোভ, অবরোধ ও মারামারি করছে। খোলা আকাশের নিচে সারারাত নির্ঘুম রাত কাটানো, উন্মক্ত স্থানে প্রাকৃতিক কাজ সারার চিত্র নগরবাসীর চোখে পড়ে। সর্বশেষ মঙ্গলবার দুপুরে কয়েকশ’ বিক্ষোভকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দিকে ছুটে যান। পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দিলে আবারও টিকেট কাউন্টারের সামনে অবস্থান নেন। গত সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের সোনারগাঁও হোটেলে দুটো প্রবেশমুখ ও মতিঝিলে অবস্থান করতে দেখা গেছে। অনেকে চিৎকার করতে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেছে নিজ ঘরে। সাউদিয়ার টিকেট এমন হাহাকারে পথচারীদের সহানুভূতি চোখে পড়লেও সরকারেরর কোন দায়িত্বশীল মহলেরই টনক নড়েনি। সবাই যেন নির্বিকার। দুদিন ধরে টিকেট না পেয়ে নাজির মামুদ গ্রামে ফিরে যাওয়ার আগে দুপুরে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেতে না পারলে আমার আর যাওয়া হবে না। কারণ ভিসার মেয়াদ শেষ এদিন। ভিসার মেয়াদ যদি না বাড়ানো হয় তাহলে আমার মতো এমন হাজার হাজার যুবক সর্বস্ব হারাবে। উদ্ভুত পরিস্থিতি সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত জাভেদ পাটওয়ারী, বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান, সিনিয়র সচিব মহিবুল হক, পররাষ্ট্র সচিব ও অন্য কর্মকর্তারা সৌদি প্রবাসীদের আকামার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য একযোগে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা যে কোন মূল্যে আকামা আটকে পড়া প্রবাসীদের আকামার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে সৌদিকে অবহিত করেছেন বলে জানা গেছে। সর্বশেষ গত রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সৌদির সঙ্গে বিমান চলাচল পুনরায় চালু করা নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তা সমাধান করা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং সৌদি এয়ারলাইন্স আজ সেপ্টেম্বর থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করবে। এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, সৌদি আরব ৭ ফ্লাইট চেয়েছিল, দুটো দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও দেয়া হবে তবুুও যেন আটকে পড়া প্রবাসীদের দ্রুততম সময়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায়। এ বিষয়ে সৌদিরও উচিত বিমানকে নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইটের অনুমতি দেয়া। এ বিষয়ে বেবিচকের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। এদিকে গত ক’দিন ধরে সোৗদিতে ফেরার জন্য আটকে পড়া শ্রমিকরা টিকেটের জন্য চরম ভোগান্তির শিকার হলেও তাদের দেখার কেউ নেই। সবাই দূরে থেকে যার যার অবস্থান থেকে মিডিয়ার সঙ্গে দায়সারা কথা বললেও ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ যাত্রীদের সান্ত¦না বা কোন আশ্বাসের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এতে এসব যাত্রীদের অনেকেই আশালীন ভাষায় গালিগালাজ করতে দেখা যায়। ঢাকায় সাউদিয়া এয়ারের সেলস ইনচার্জ ওমরের বিরুদ্ধে টিকেট নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন অনেকেই। হাসান নামের এক যুবক বলেন, আমার ভিসা মেয়াদ শেষ ৩০ সেপ্টেম্বর। আমাকে রিটার্ন টিকেটের রিইস্যু টোকেন দেয়া হয়নি গত দুদিন ধরেও। অথচ অক্টোরের যাত্রীদের দেয়া হয়েছে টোকেন। শুধু টাকার বিনিময়ে এটা সম্ভব হচেছ। রিটার্ন টিকেট থাকা সত্ত্বেও ২০/২৫ হাজার খরচ করে অনেকেই টিকেটের টোকেন পেয়েছে। প্রকাশ্যে এমন দুর্নীতির ভুরি ভুরি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। প্রতিকার নেই- সবাই নির্বিকার। টিকেট সঙ্কট পরিস্থিতি সরজমিনে দেখা যায়, মঙ্গলবার সকাল থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও হোটেলে সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিসের বাইরে অবস্থান নেয় তারা। এ সময় সোনারগাঁও হোটেলের গেট বন্ধ করে রাখা হয়। প্রবাসীদের একটা অংশ গেটের সামনে অবস্থান করেন। প্রবাসীদের পাশাপাশি পুলিশও শক্ত অবস্থান নেয়। ফলে প্রবাসীরা মূল রাস্তা থেকে সরে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। প্রবাসীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়ায় যানচালাচল অব্যাহত থাকে। সোমবারও কারওয়ান বাজারে প্রবাসীরা বিক্ষোভ করেছিলেন। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সময়মতো না যেতে পারলে চাকরি হারিয়ে নিঃস্ব হবেন অনেকে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অন্যতম নোয়াখালীর মোঃ এনামুল বলেন, সৌদি এয়ারলাইন্সের টিকেট কেটেছিলাম। তবে যেতে পারিনি। আমাদের আকামার মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। কয়েক দিন ধরে এখানেই আছি। দীর্ঘদিন দেশে থাকতে থাকতে সবারই বাড়িতে অনেক ধারদেনা হয়ে গেছে। আমাদের যেতেই হবে। প্লিজ আমাদের সৌদি ফেরানোর ব্যবস্থা করেন। আগের দিন সোমবার প্রবাসীদের বিক্ষোভের মুখে ১০ প্রতিনিধিকে ভেতরে নিয়ে যায় সৌদি এয়ারলাইন্স। তাদের মাধ্যমে অন্যদের টিকেট সংগ্রহের সিরিয়ালের টোকেন দেয়া হয়। তবে আজ কোন ঘোষণা না দিয়েই অনির্দিষ্টকালের জন্য অফিস বন্ধ করে দেয় তারা। এ কারণেই বিক্ষোভে নামেন প্রবাসীরা। জানা গেছে, কারওয়ান বাজার মোড়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে সৌদি আরব থেকে ছুটিতে এসে আটকে পড়া প্রবাসীরা। তবে দীর্ঘ তিন ঘণ্টা পর তারা অবরোধ তুলে নেয়। দুপুরে তারা সমস্যা সমাধানের দাবি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে যাত্রা করে। তাছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মতিঝিল কার্যালয় অবরুদ্ধ করেন প্রবাসীরা। মঙ্গলবার সকাল থেকে কয়েক শ’ প্রবাসী বিক্ষোভ করেন। প্রথমে তারা কারওয়ান বাজারে সৌদি এয়ারলাইন্স এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন। পরে মতিঝিলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কার্যালয় অবরুদ্ধ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও করেন তারা। এ সময় টিকেটের দাবিতে তারা নানা স্লোগান দেন। এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, টিকেট জটিলতা সমাধানের দাবিতে প্রবাসীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিলেন। বিক্ষোভের খবর পেয়ে আমরা সেখানে ছুটে যাই এবং তাদের বোঝাতে সক্ষম হই যে, রাস্তা অবরোধ করে এর সমাধান হবে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে সমাধান করার পরামর্শ দিলে তারা অবরোধ তুলে নিয়ে চলে যান। তবে জানতে পেরেছি তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে গেছেন। এর আগে সকাল নয়টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত কারওয়ান বাজার মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিলেন সৌদি প্রবাসীরা। এতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। থেমে যায় পরিবহন চলাচল। পরে জনদুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রেখে অবরোধ থেকে সরে যান বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছে- সৌদি আরব থেকে যারা ছুটিতে দেশে এসেছিলেন ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের বেশির ভাগের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এটি নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন তারা। এ অবস্থায় দ্রুত সৌদি আরবে ফিরে যেতে না পারলে চাকরি যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন তারা। তাদের অভিযোগ, যাদের এটির দায়িত্ব তারা খামখেয়ালি করছেন। মোঃ রায়হান ফরহাদ নামের একজন প্রবাসী বলেন, ২৮ সেপ্টেম্বের আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হবে। এর আগে সৌদি যাওয়ার টিকেট না পেলে সেখানে আর ঢুকতে পারব না। ভিসার মেয়াদও বাড়াতে পারব না। সেইসঙ্গে চাকরিও চলে যেতে পারে। এখানে যারা বিক্ষোভ করছে তারা সবাই একই সমস্যায় ভুগছেন।
×