ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাড়ে ছয় কোটি টাকার তহবিল তসরুফ ॥ দুর্নীতির আখড়া শূটিং ফেডারেশন (পর্ব-১)

প্রকাশিত: ১৯:৫১, ১ জুলাই ২০২০

সাড়ে ছয় কোটি টাকার তহবিল তসরুফ ॥ দুর্নীতির আখড়া শূটিং ফেডারেশন (পর্ব-১)

রুমেল খান ॥ বাংলাদেশ যে গুটিকয়েক খেলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ সাফল্য পেয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শূটিং। নব্বই দশকে সার্ক সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শূটিংয়ে ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন কারণে শূটিংয়ে অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। গোলা-বারুদের এ খেলাটিতে মাঝে মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায় এ ক্রীড়া ডিসিপ্লিনটি। কেউ কেউ মাঝে-মধ্যেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাল নৈপুণ্য দেখান। কিন্তু তাদের নৈপুণ্যে নেই তেমন কোন ধারাবাহিকতা। তার ওপর যদি যোগ হয় ফেডারেশনের কোন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগের পাহাড়, তাহলে সেই ফেডারেশনের কার্যক্রম, খেলা, সাফল্য ... সবকিছুই স্থবির-ম্লান হয়ে যেতে বাধ্য। আজকের প্রসঙ্গ বাংলাদেশ শূটিং স্পোর্ট ফেডারেশন (বিএসএসএফ)। এই ফেডারেশনের মহাসচিব পদে বছর আটেক ধরে আছেন ইন্তেখাবুল হামিদ (অপু)। দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতে তার পদের নাম ছিল সাধারণ সম্পাদক। পরে নির্বাহী কমিটির অনুমোদন নিয়ে পদের নাম পরিবর্তন করে ফেলেন তিনি। পদের নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার কাজের ধরন ও ব্যবহারও কি পরিবর্তন হয়ে যায়? তার ‘বিরোধী’দের অন্তত সে রকমই ধারণা। তারাই গত বছরের ফেডারেশনের বার্ষিক সাধারণ সভায় ফেডারেশনের কাউন্সিলরদের কাছে পাঠানো হয় তিনটি বেনামি চিঠি। প্রতিটি চিঠিই লেখা হয়েছে ফেডারেশনের একজনের নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি-স্বেচ্ছাচারিতা-দুর্নীতি নিয়ে (মোট ১০টি অভিযোগ)। তার নাম ইন্তেখাবুল হামিদ! স্বভাবতই সে চিঠিগুলো তুমুল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে গোটা ফেডারেশনে। এরপর ওই বছরের জুলাইয়ের শেষদিকে ওই বেনামি চিঠিগুলোর আনীত অভিযোগ এবং দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। গঠন করা হয় তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। যাতে ছিলেন হোসনে আরা বেগম (আহ্বায়ক), জিয়াউদ্দিন আহমেদ (সদস্য) এবং ইয়াসমিন গফুর পিপিএম (সদস্য)। তদন্ত কমিটি কর্তৃক বেনামি পত্রসমূহ পর্যালোচনা করে তদন্তের পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। সে মোতাবেক সংশ্লিষ্ট উপ-পরিষদসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহ্বায়কদের অনুসন্ধান কার্যক্রমে সহায়তা করার জন্য তিন দফায় চিঠি পাঠানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপ-কমিটির আহ্বায়কদের কাছ থেকে প্রথমে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ফলে পরে উপ-কমিটির অন্য সদস্যদের চিঠি দিয়ে তদন্ত কমিটির কাছে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়। সেভাবেই সাক্ষীদের জবানবন্দী লিখিত ও মৌখিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও তদন্তের স্বার্থে ১০টি অভিযোগ শনাক্ত করে গোপন অনুসন্ধান করা হয়। দীর্ঘ অনুসন্ধান ও কার্যক্রম শেষে এ বছরের মার্চে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে ফেডারেশনের সভাপতি নাজিমউদ্দিন চৌধুরী কাছে। প্রতিবেদন ছিল ৫০ পৃষ্ঠাব্যাপী। এতে মোট ২৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। মহাসচিব তার বক্তব্য দিতে বেশ কালক্ষেপণ করেন। বেনামি চিঠিতে প্রথম অভিযোগ ছিল এ রকম : ‘গত ২৯-০৭-২০১৯ তারিখে ফেডারেশনের নির্বাহী সভায় ফেডারেশনের মহাসচিব দুই কোটি টাকা লোন নেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এদিকে ফেডারেশনের দেনার পরিমাণ সাড়ে ছয় কোটি টাকা। আরও দুই কোটি টাকা লোন না বাড়ানোর পক্ষে অধিকাংশ সদস্য মতামত দেন। শূটিং ফেডারেশনের সাড়ে ৬ কোটি টাকা দেনার বিষয়ে তহবিল তসরুফ হয়েছে।’ এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাক্ষ্য দেন আব্দুস সালাম খান (আহ্বায়ক, অর্থ উপ-পরিষদ, বিএসএসএফ), কায়সারুল ইসলাম (ট্রেজারার, বিএসএসএফ), শীষ হায়দার চৌধুরী (সদস্য, বিএসএসএফ) এবং মোহতাসিম মেহেদী (সদস্য, অর্থ উপ-পরিষদ, বিএসএসএফ)। তদন্ত কমিটির কাছে সালাম জানান, ‘সাড়ে ছয় কোটি টাকা ফেডারেশনের দেনার বিষয়ে ২৯-০৭-২০১৯ তারিখে অর্থ উপ-পরিষদের সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং ফখরুদ্দিন ফুডসের কাছ থেকে ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়নি।’ মোহতাসিম জানান, ‘... পরবর্তীতে কার্যনির্বাহী সভায়ও উক্ত ঋণের বিষয়টি অনুমোদন হয়নি। ... অর্থ উপ-পরিষদের সভা অনিয়মিতভাবে হয়, ফলে ভাউচারগুলো সার্বিকভাবে দেখা সম্ভব হয় না। র‌্যান্ডমলি দেখা হয়। প্রায় প্রতি সভায় মহাসচিব উপস্থিত থাকেন।’ তদন্ত কমিটি অনুসন্ধানে যা পেয়েছে, তা হলো- সালাম এবং কায়সারুলের বক্তব্য ও দাখিলকৃত দায়-দেনার দলিল/তথ্যাদি থেকে দেখা যায় যে, ২৯.০৭.২০১৯ তারিখ পর্যন্ত ফেডারেশনের মোট ছয় কোটি ২৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫২২ টাকা দেনা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেনাগুলো হচ্ছে বিভিন্ন ক্লাব থেকে অস্ত্র আমদানির জন্য অগ্রিম গ্রহণ ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ফখরুদ্দিন ফুডস লিমিটেডের অপরিশোধিত ৭৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, মিলনায়তন ভবন সংস্কার ও মেরামতের জন্য অপরিশোধিত ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৫৭ হাজার ৭৮৮ টাকা, ৫০ মিটার রেঞ্জ বুকিং বাতিল বাবদ ৬ লাখ টাকা, দুই কৃতী শূটার আবদুল্লাহ হেল বাকী ও শাকিল আহমেদকে (২০১৮ সালে তারা কমনওয়েলথ গেমস শূটিংয়ে রৌপ্যপদক পেয়েছিলেন) প্রাইজমানি হিসেবে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৪ লাখ টাকা না দেয়া। অন্যান্য খাতে অপরিশোধিত দেনা ৫৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭৩৪ টাকা। ফেডাশেনের তিন বছরের (২০১৭-১৯) অর্থবছরের বার্ষিক অডিট রিপোর্ট দেখেছে তদন্ত কমিটি। সেখানে তারা কোন বছরের রিপোর্টে কোন আর্থিক অনিয়মের লক্ষণ পায়নি। (চলবে)
×