ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূকাভিনয়- পৃথিবীর আদিম ভাষা, আজও সমাদৃত

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২৫ নভেম্বর ২০১৯

  মূকাভিনয়- পৃথিবীর আদিম ভাষা, আজও সমাদৃত

সমুদ্র হক ॥ পৃথিবীর আদিলগ্নে মানুষের কোন নির্দিষ্ট ভাষা ছিল না। মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র উপায় ছিল ইশারা-ইঙ্গিত। মানুষের অদিপুরুষ হোমোস্যাপিয়েনরা কোন ভাষায় কথা বলত জানা না গেলেও ইশারাই যে ছিল মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম তা ধরে নেয়া যায়। ধীরে ধীরে সভ্যতা। সভ্যতার উৎকর্ষে পৌঁছাতে ইশারা অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরে একটি নতুন শিল্পমাধ্যম তৈরি হয়। একেই বলা হয় মূকাভিনয়। বিশ্বের বহু দেশে সমাদৃত। মূকাভিনয় অতি সূক্ষ্ম ও জটিল এক শিল্পকলা। উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে এই শিল্পের প্রসার বাড়ছে। বিষয়টি যেহেতু সূক্ষ্ম ও জটিল এ কারণে মূকাভিনয় বুঝতে দর্শকদেরও প্রস্তুতি দরকার। এই সূক্ষ্ম মূকাভিনয় উপভোগের জন্য দর্শকদেরও উপলব্ধি থাকতে হয়। নইলে তারা অনেক কিছুই ধরতে পারবেন না। ইউরোপের দর্শকদের মতো আমাদের দর্শকদেরও এজন্য চাই মূকাভিনয় বোঝার জ্ঞানার্জন করা। মূকাভিনয়কে বলা হয় বারো অঙ্গের খেলা। মানবদেহের বারোটি অঙ্গ নিয়ে শরীরী ও সাঙ্কেতিক ভাষার মধ্য দিয়ে এসেছে মূকাভিনয়। এই অভিনয় ভাব-রস প্রকাশ করে। হাতের সঞ্চালনে প্রকাশ পায় অর্থ। বারো অঙ্গের এই মূকাভিনয় দর্শকদের কাছে চরিত্র ভাবনা ও ভাব-রস পৌঁছে দেয়। এভাবেই সমাদৃত এই শিল্পমাধ্যম। জায়গা করে নিয়েছে হাজারো দর্শক হৃদয়ে। মূকাভিনয় এমন এক শিল্প মাধ্যমে যা মৌনকে মুখর করে তোলে। আমরা দর্শকরা এটুকুই প্রত্যক্ষ করি। শিল্পী থাকেন মৌন। তার দেহ বল্লরীতে নানা ভঙ্গিমায় মূর্ত হয়ে ওঠে ভাষা, আশ্চর্য এক সৃজনকৌশল। সাস্ত্রীয় অঙ্গাভিনয় এখনও মুদ্রানির্ভর, টিকে আছে ধ্রুপদি নৃত্যকলায়। বিশেষ করে মনিপুরী নৃত্যে। মানবদেহের বারোটি অঙ্গ নিয়ে মূকাভিনয়ের এই যে ভাষা তাকে অঙ্গ উপঅঙ্গ এই দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মাথা, হাত, কটিদেশ, বক্ষ, পাশর্^ ও পা এগুলো অঙ্গ। উপঅঙ্গ হলো : চোখ, ভ্রু, নাক, ঠোঁট, গাল, চিবুক। মূকাভিনয়ে শিল্পীকে এই বারোটি মুদ্রা কাজে লাগাতে হয়। এতেই প্রকাশ ভাব ও রস। যে কোন অর্থ প্রকাশে ভাব ও রসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মুদ্রার যথেচ্ছ ব্যবহার হয়। হাতের লৌকিক মুদ্রা আছে। শরীর অভিনয়ের মধ্যে পড়ে বুক পেট পাশ কোমর উরু জঙ্ঘা ও পায়ের অভিনয়। পায়ের বিভিন্ন ভঙ্গির সঙ্গে কোমর উরু ও জঙ্ঘা জড়িয়ে আছে। শৈলী পাল্টেছে মূকাভিনয়ে শৈলী পাল্টেছে প্রকাশের নৃত্যকলায়। অঙ্গাভিনয় শৈলী অন্য এক স্টাইল। সাধারণ নাটকেও অভিনেতাকে অনেক সময় মূকাভিনয় করতে হয়। যেমন- এক বালক রান্নাঘরে খাবার খুঁজছে। এই খোঁজার পেছনে থাকতে পারে নানা কারণ। যেমন- এক. সে ক্ষুধার্ত, দুই. চুরি করে খাওয়ার অভ্যাস আছে, তিন. কৌতূহলে খাবার দেখতে এসেছে। এই তিন কারণের সঙ্গে মূকাভিনয়ে যুক্ত হবে তার ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি। হাঁটা চলা অঙ্গ সঞ্চালনে তারতম্য ঘটিয়ে বিভিন্ন মনোভাব ব্যক্ত হবে। আরেকটি উদাহরণ প্রণয়প্রার্থী মানুষটি রাস্তায় অপেক্ষা করছে। তার অভিব্যক্তি রোমান্টিকতার মধ্যে অন্য ভাব-রস ফুটে উঠবে। আমরা সাঙ্কেতিক কুশলাদি জিজ্ঞেস করি চোখের পাতার নাচনে। আবার চোখের পাতার নাচনের সঙ্গে হাত ও মুখের বিভিন্ন ইশারা অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে পারে। ঠোঁটে কয়েকটি আঙ্গুলের ভেতর দিকে সামান্য ঠেকিয়ে উড়িয়ে দেয়ার ইঙ্গিত সেই ফ্লাইং কিস এখন সবাই বোঝে। একদা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ছিল বিদ্রুপাত্মক। এখন পছন্দের ভাল সাইন (ফেসবুকের সিম্বলিক)। সকালে ঘুম থেকে জাগার পর দুই হাত ছড়িয়ে ব্যায়ামের মতো করি- এটা ইঙ্গিত। আমরা প্রতিনিয়ত এভাবে আমাদের বারো অঙ্গের ছন্দায়িত ব্যবহারে মৌন থেকেও প্রকাশ করছি অনেক কথা। ‘এমন অনেক কথাই বলো তুমি মন থেকে যা বলো না/আবার এমন অনেক সত্যি কথা আমি ভাবি ছলনা’ সতীনাথ মুখার্জীর এই গানেও আছে মূকাভিনয়ের ইঙ্গিত। প্রচলিত মঞ্চাভিনয়ে অনেক বস্তু থাকে। আধুনিক মূকাভিনয়ে কোন বস্তু যেমন দরজা জানালা সিঁড়ি দেয়াল কিছুই থাকে না। এ এক নতুন ছন্দ। সমস্ত ক্রিয়ার পেছনে সক্রিয় থাকে মনের ভাবনা। মূকাভিনয়ে মুখম-লকে সাদায় ঢেকে দিয়ে অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গের গুরুত্ব বৃদ্ধি ঘটাতে হয়। এখানেই এই শিল্প স্বতন্ত্র। দেহের পুঙ্খানুপুঙ্খ অলঙ্করণে ঘটনাকে সংলাপবিহীন উপস্থাপনেই দর্শক আকর্ষণ। বাংলাদেশে মূকাভিনয়ে পথিকৃত হিসেবে আজও যার নাম জড়িয়ে আছে তিনি পাবনার ছেলে পার্থপ্রতীম মজুমদার। বর্তমানে ফ্রান্স প্রবাসী। দেশ স্বাধীনের পর সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসে নাটক। পাশাপাশি আধুনিক শিল্পকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয়ে মূকাভিনয় চর্চায় এগিয়ে আসে কিছু তরুণ। এক পর্যায়ে থিতু হয়ে যায়। প্রতিভাবান এই কর্মীদের চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর প্রকাশ পায় ‘নির্বাক’ নামে একটি সংগঠন। মূল সংগঠক ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের তৎকালীন ছাত্র ফরহাদ হাসান সিদ্দিকী মিঠু। ব্রিটিশ কাউন্সিল ও রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারের সহযোগিতায় তিনি শিক্ষিত মূকাভিনেতা গড়ে তোলেন। এরপর থেমে যায়। বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সংগঠন এগিয়ে আসছে। মূকাভিনয়ের ইংরেজী শব্দ মাইম, প্যান্টোমাইম। মাইম ও প্যান্টোমাইমের উপস্থাপনায় বিশ্লেষণগত কিছুটা পার্থক্য আছে। প্যান্টোমাইম হলো- কোন একটি গল্পের বিষদ ব্যাখ্যা। মাইমও একটি গল্পের বর্ণনা দেয়। মঞ্চসজ্জা ও ঘটনার বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে এ্যাবস্ট্রাক্ট ও সিম্বলিক উপস্থাপনা মাইমের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। প্যান্টোমাইমের বিষয়গুলো অনেকটাই সহজ সরল, মাইম ততটা নয়। মাইম উপস্থাপিত গল্পের ব্যাখ্যার ফল অনুভূতির সঙ্গে মিশে একটি ভাবের জন্ম দেয়। একটি ভাল মাইমকে প্যান্টোমাইমের মতো দ্রুততার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে এগোতে হয়। রবীন্দ্র গবেষক, সাহিত্যিক সাংবাদিক সুজিত কুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন- জগত বিখ্যাত নাট্য অভিনেতা স্যার লরেন্স লন্ডনের এক থিয়েটারে ১৯৫০ সালে একটি নাটকের শেষের দৃশ্যে জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করলেন মৌনতার অভিব্যক্তি দিয়ে। দৃশ্যটা ছিল এ রকম- টেলিগ্রাম পড়লেন। তীব্র বেদনা ব্যক্ত হলো মুখে। টলে উঠলেন। থরথর করে হাত ও শরীর কাঁপছে। হাত থেকে খসে পড়ল টেলিগ্রামের কাগজ। দু’চোখে নামল অশ্রু। আশ্চর্য ভাবে তাকিয়ে রইলেন। ভাষাহীন এই উদাস চোখে ব্যক্ত হলো তীব্র বেদনা- সেই চোখের দিকে তাকানো যায় না। বেহালার সুরে দর্শকরা বিস্ময়ে দেখল অপার্থিব এই দৃশ্য। নাটক শেষে স্যার লরেন্স বললেন, চিৎকার করে সাজানো ভাষায় অনেক কিছুই ব্যক্ত করার মতো নয়। তা অতিনাটকীয় মেলোড্রামা। বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নিজের হৃদয়ের গভীরতায় ডুব দিয়ে মৌন অভিব্যক্তিতে আনন্দ বেদনা জীবনের কথার প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। মূকাভিনয় অতিশয় সূক্ষ্ম এবং জটিল শিল্পকলা। এটা বোঝার জন্য আমাদের দর্শকদেরও ইউরোপের দর্শকদের মতো সূক্ষ্ম অভিনয় উপভোগের যোগ্য করে তুলতে হবে। সেজন্য সমবেত চেষ্টা দরকার। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, শিল্পকলা একাডেমিও।
×