ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

১৭ বছরে বিচার হয়নি মডেল তিন্নি হত্যার, আলোচিত অভি কোথায়?

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২২ জুলাই ২০১৯

 ১৭ বছরে বিচার হয়নি মডেল তিন্নি হত্যার, আলোচিত অভি  কোথায়?

শংকর কুমার দে ॥ আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিসে রয়েছেন চাঞ্চল্যকর মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলার একমাত্র আসামি, এক সময়ের আলোচিত-সমালোচিত ছাত্রনেতা ও জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভি। ২০০২ সালের ১০ নবেম্বর রাতে মডেল তিন্নি খুন হওয়ার পর থেকেই দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে গিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান তিনি। দীর্ঘ ১৭ বছরেও তিন্নি হত্যার যেমন বিচার হয়নি, তেমনি হদিস না পাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে অভি এখন কোথায়? সাবেক জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতা ও পরবর্তীতে জাতীয় পার্টির এমপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের অস্ত্রবাজ ছাত্র নেতা ছিলেন অভি। আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজধানী ঢাকার মানুষ অভি-নীরু নাম শুনলেই বাঘে মোষে পানি খেত এক ঘাটে। অভি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে আদালতের নথিপত্রে উল্লেখ থাকলেও তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোন উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয়নি। পলাতক থাকা অবস্থায়ই হাইকোর্টে রিট আবেদনের মাধ্যমে মামলাটির স্থগিতাদেশ পান অভি। এরপর থেকে তার আর হদিস নেই। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ঢাকা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সপ্তম আদালতে মামলাটি পড়ে আছে বছরের পর বছর। পরবর্তীতে স্থগিতাদেশ বাতিল হওয়া সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র আদালতে না যাওয়ায় মামলাটির কার্যক্রম একপ্রকার থমকে রয়েছে। আদালত সূত্র জানায়, গত ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম বিদেশ থেকে এসে আদালতে আংশিক সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর পর একই বছরের ২৫ আগস্ট মামলাটির কার্যক্রম উচ্চ আদালত স্থগিত করলে তিনি বিদেশে চলে যান। ফলে বছরের পর বছর ধরে আলোচিত মডেল তিন্নি হত্যা মামলটি ঝুলে আছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালের ১০ নবেম্বর রাতে খুন হন মডেল তিন্নি। এর আগে ৬ নবেম্বর তিন্নিকে তার স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করেন অভি। ওই দিনই অভি পিয়ালকে তার কোলের দেড় বছর বয়সী কন্যা সস্তানসহ রাজধানীর বাড়ি থেকে বের করে দেন। এর পর বিয়ে করার জন্য অভিকে চাপ দিতে থাকেন তিন্নি। একপর্যায়ে তিন্নি বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেন। ১০ নবেম্বর রাতে তিন্নির মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। এরপর গুমের উদ্দেশে ওই রাতেই গাড়িতে বুড়িগঙ্গায় ১নং চীন মৈত্রী সেতুর ওপর থেকে নদীতে নিয়ে তিন্নির লাশ ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু পানিতে নয়, লাশটি পড়ে পিলারের উঁচু অংশে। পরদিন ১১ নবেম্বর সকালে লাশ ঘিরে সেখানে উৎসুক জনতার ভিড় জমে। কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে সুরতহালের পর ময়নাতদন্ত করে। মর্গে চারদিন রাখার পর ১৫ নবেম্বর অজ্ঞাত হিসেবেই জুরাইন কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। এদিকে তার চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হারানো ডায়েরি করেন। লাশ উদ্ধারের দিনই একই থানায় একটি হত্যা মামলা করেন একই থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মোঃ শফি উদ্দিন। অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের তাতে আসামি করা হয়। এরপর সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছোট্ট সংবাদের সূত্র ধরে তিন্নির স্বজনরা আঞ্জুমানে মুফিদুলে যান। ছবি দেখেই চিনে ফেলেন তাদের প্রিয় তিন্নির লাশ। এর পরই ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন একই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোঃ কাইয়ুম আলী সরদার। পরে মামলাটিতে অভির নাম উঠে এলে তা নিয়ে আরও হৈচৈ পড়ে যায়। চাঞ্চল্যকর বিবেচনায় মামলাটির ভার পড়ে সিআইডির ওপর। প্রথমদিকে দুই সিআইডি পরিদর্শক মোঃ ফজলুর রহমান ও সুজাউল হক তদন্ত করেন। এরপর যথাক্রমে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা, মোঃ আরমান আলী, কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ মামলাটি তদন্ত করেন। অবশেষে মামলার ৭ম তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি মোঃ মোজাম্মেল হক ২০০৮ সালের ৮ নবেম্বর মামলাটির তদন্ত শেষ করেন। প্রথমে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও পরে মামলা স্থানান্তরিত হয় সিআইডিতে। তার ৬ বছর পর গত ২০০৮ সালের ৮ নবেম্বর একমাত্র আসামি গোলাম ফারুক অভিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দেয় সিআইডি পুলিশ। ওই মামলায় বিভিন্ন সময় তিন্নির স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না পাওয়ায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পুলিশী তদন্তে প্রাথমিকভাবে অভি অভিযুক্ত হলেও তাকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। আর অভির অনুপস্থিতিতেই ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঢাকার ৭ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ তিন্নি হত্যা ও মরদেহ গুমসংক্রান্ত মামলায় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের পর তাকে গ্রেফতারের জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা আছে। মডেলকন্যা তিন্নির স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালের মাধ্যমেই তিন্নির সঙ্গে অভির পরিচয় হয়। এরপর তিন্নি ও অভির ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। স্বামী পিয়াল বিষয়টি ভালভাবে নিতে পারেননি। একপর্যায়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অভির কথায় গত ২০০২ সালের ৬ নবেম্বর পিয়ালকে ডিভোর্স দেন তিন্নি। আর অভির ইচ্ছা ছিল, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিন্নির কাছ থেকে শুধুই সুবিধা নেয়া। বিয়ে করে তিন্নিকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়ার ইচ্ছা অভির ছিল না। এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই তাকে বিয়ে করার জন্য তিন্নি অভিকে চাপ দিতে থাকেন। অভি বিয়ে করতে অস্বীকার করলে সব গোপন খবর মিডিয়ায় ফাঁস করার হুমকি দেন তিন্নি। এক পর্যায়ে গত ২০০২ সালের ১০ নবেম্বর গভীর রাতে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে তিন্নির লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানার অতিরিক্ত উপ পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) সফি উদ্দিন থানায় মামলা করেন। সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এক সময়ের আলোচিত-সমালোচিত ছাত্রনেতা গোলাম ফারুক অভি এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে। কোথায় আছেন, কেমন আছেন তা যেন কেউ জানে না। এক সময়ের তার সতীর্থ হিসেবে পরিচিতরাও রয়েছেন অন্ধকারে। তবে এতটুকু তারা জানিয়েছেন, অভি মামলা জটিলতার কারণে এখন কানাডায় আত্মগোপনে। আর এ কারণে বছরের পর বছর ধরে দেশত্যাগী সাবেক এই ছাত্রনেতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোন খবরেই। দেখাও মিলছে না কোথাও। পারিবারিক সূত্রগুলোও তার অবস্থানের বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। মডেল তিন্নি হত্যা মামলার খন্ড মাথায় নিয়ে দেশছাড়া সাবেক এই ছাত্রনেতাকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে কৌতূহল এখনও রয়েছে।
×