ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

লৌহজংয়ে ফের পদ্মার ভাঙ্গন

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ৯ আগস্ট ২০১৮

লৌহজংয়ে ফের পদ্মার ভাঙ্গন

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ লৌহজং উপজেলার মানচিত্রে আবারও আঘাত হেনেছে রাক্ষুসী পদ্মা। বার বার ভাঙ্গনে নিজেদের বসতভিটা হারিয়ে যে মানুষগুলো আশ্রয়হীন হয়ে সরকারী আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয় নিয়েছিল, এবার পদ্মা সেই আশ্রয়ণ প্রকল্পে আঘাত হেনেছে। ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২২টি পরিবারের লোককজন এখন প্রায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। প্রদত্তা পদ্মার রাক্ষুসী থাবার অপেক্ষায় এখন এ পরিবারগুলো শুধুই পদ্মার দিকে তাকিয়ে থাকে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৮টি ব্যারাকের মধ্যে ৪টি ব্যারাক ঘেঁষে প্রবাহিত হচ্ছে উত্তাল পদ্মা। উপজেলার পাইকারা আশ্রয়ণ প্রকল্প সরেজমিনের পরিদর্শন শেষে লৌহজং উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিনাত ফৌজিয়া জানান, যে কোন সময় নদী গর্ভে চলে যেতে পারে এই চার ব্যারাক। মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় আশ্রয়ণ পরিবারের লোকজনের মুখে হতাশার ছাপ। একটা অজানা ভয় কাজ করছে সকলের মাঝে। সব কিছু হারানো এই মানুষগুলো আশ্রয় পেয়েছিল সরকারী এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে। বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল সংসার। কিন্তু বর্ষার শুরু থেকেই নদী ভাঙ্গনের আশঙ্কা তাদের মাঝে কাজ করছিল। কিন্তু সে আশঙ্কা এখন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার ভাঙ্গনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পদ্মা গ্রাস করেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বড় বড় গাছ। খাবার পানির একমাত্র গভীর নলকূপটি এখন পদ্মার মুখে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা ইতোমধ্যে তাদের আবাবপত্র হাঁড়ি-পাতিল অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। কিন্তু তারা কোথায় যাবে তাও জানে না। ১১০ বছরের বরুনি বিবি বলেন, বাবারে অনেক কষ্টে এখানে মাথা গুঁজার ঠাঁই পেয়ে ছিলাম। রাক্ষুসী পদ্মা তো তাও কাইড়া নিতেছে। অহন কই যামু কইতে পারতাছি না। একই রকম কথা বললেন ৫৫ বছরের বাসিন্দা এনায়েত উদ্দিন। তিনি জানালেন, মাথায় এখন তার অনেক চিন্তা। সরকার ঠাঁই দিয়েছিলেন এই আশ্রয়ণ কেন্দ্রে কিন্তু পদ্মা তো আবার রাস্তায় নামিয়ে দিতাছে। সরকার কি আমাগো আবারও থাকার ব্যবস্থা করবো? লৌহজং-তেউতিয়া ইউনিয়নের মেম্বার রুহুল আমিন জানান, শুধু আশ্রয়ণ প্রকল্পই নয়, পদ্মায় ভাঙছে এ ইউনিনের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। পাইকারা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৮টি ব্যারাকে রয়েছে। প্রতিটি ব্যারাকে ১০টি করে পরিবারের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সে মতে ৮০ পরিবারের এখানের বসবাসের ব্যবস্থা থাকলেও এখানে ২২টি পরিবার তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে বসবাস করছে। ৪টি ব্যারাক খুবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আজ রাতের (মঙ্গলবার) মধ্যেই এগুলো পদ্মায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ পরিবারগুলোকে কিভাবে আবারও আশ্রয় দেয়া যায় তা সরেজমিনে দেখে গেছেন উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের লোকজন। এ দিকে ভাঙ্গন শুধু পাইকার আশ্রয়ণ প্রকল্পেই লাগেনি। ভাঙ্গন ছড়িয়ে পড়েছে লৌহজং উপজেলার বিস্তীর্ণ পদ্মা পার জুড়ে। কোথাও ভাঙছে দ্রুততার সঙ্গে আবার কোথাও ভাঙনে ধীর গতিতে। বসত বাড়ির পাশাপাশি ভাঙছে পদ্মা চরের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ভেঙ্গে যাচ্ছে খড়িয়া গ্রামটি। সর্বনাশা পদ্মায় আর কত দুঃখ দিবে এ গ্রামের মানুষজনকে সেও জানে না এ অসহায় মানুষগুলো। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাজেদা সরকার জানিয়েছেন, ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের লোকদের অন্যত্র সরিয়ে আনার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে সরকারী খাস জায়গা চেয়ে পত্র দেয়া হয়েছে। জায়গা পেলে তাদের জন্য নতুন করে আশ্রয়ণের ব্যবস্থা করা হবে। মঙ্গলবার বিকেলে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মনির হোসেন জানিয়েছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভাঙ্গন কবলিতদের পাশের একটি বৃদ্ধাশ্রমে সরিয়ে নেয়া হবে। তাদের গবাদি পশুও সেখানে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। পরবর্তীতে সুবিধা মতো জায়গা দেখে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। শিশুরা পা বাড়ালেই অথৈ নদী সংবাদদাতা নেত্রকোনা থেকে জানান, জেলার কলমাকান্দা উপজেলার বড়খাপন ইউনিয়নের নাগারগাতী গ্রামে অবস্থিত রিকা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবনটি নদী ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। ফলে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম। এরই মধ্যে বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ এবং রাস্তাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। জানা গেছে, ১৯৭০ সালে নাগারগাতী মৌজায় রিকা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৯ সালে সরকারী উদ্যোগে নির্মাণ করা হয় দ্বিতল পাকা ভবন। ভবনের ঠিক দক্ষিণ পাশ দিয়েই বয়ে গেছে খর¯্রােতা শাখাই নদী। বর্ষায় এ নদী দিয়ে পাহাড়ী ঢল আসে। তখন ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দেয়। গত কয়েক বছরের ভাঙ্গনে বিদ্যালয়ের আসা যাওয়ার রাস্তাসহ খেলার মাঠটি সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়। সরজমিনে দেখা গেছে, নদী ভাঙ্গন এখন বিদ্যালয়ের ভবন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এখন ভবনের দক্ষিণ পাশের সিঁড়ি এবং পিলারের নিচের অংশ ভাঙ্গতে শুরু করেছে। এভাবে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে পুরো ভবনটিই বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এ বিদ্যালয়ের ভাঙ্গনের বিষয়টি নিয়ে ২০১৫ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে একবার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিদ্যালয়টির পাশে একটি অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে ভাঙ্গন কিছুটা রোধ হয়েছিল। কিন্তু গেলবারের বন্যায় এ বাঁধটিও বিলীন হয়ে যায়। বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি বিশ্বাস বলেন, বিদ্যালয়ে শিশু থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত মোট ১শ’ ৯৭ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনজন। কোমলমতি শিশুদের নিয়ে শিক্ষকদের সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। অভিভাবকরাও ছেলে-মেয়েদের ক্লাসে পাঠাতে ভয় পান। কারণ, বিদ্যালয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পা বাড়ালেই সাঁতার পানিতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে শিশুদের। এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শ্যামল কান্তি ভৌমিক জানান, ভাঙ্গনের কবল থেকে বিদ্যালয়টিকে রক্ষার জন্য কোন কর্তৃপক্ষই কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে যে কোন সময় হেলে বা ধসে পড়তে পারে ভবনটি। তার মতে, জরুরী ভিত্তিতে গাইড ওয়াল নির্মাণ ছাড়া ভবনটি রক্ষা করা যাবে না। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জানান, ভাঙ্গনের বিষয়টি বহুবার কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ উপজেলায় আমি নতুন যোগদান করেছি। বিষয়টি সরজমিনে পরিদর্শন করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।’
×