ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আজ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ॥ ভোগান্তি এড়াতে র‌্যালি ৬ জানুয়ারি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৪ জানুয়ারি ২০১৮

আজ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ॥ ভোগান্তি এড়াতে র‌্যালি ৬ জানুয়ারি

সোহেল তানভীর ॥ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আমলে ও স্বাধীনতার পর অনেক সঙ্কটে ছাত্রলীগ ছিল আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের সংগ্রামে ঝরে গেছে বহু নেতাকর্মীর প্রাণ। রাজপথের আন্দোলনেও আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ছাত্রসংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ ও দেশরতœ শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কলম ধরি জঙ্গীবাদ ও মাদকমুক্ত দেশ গড়ি’ এই সেøাগানে আজ ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। ১৯৪৮ সালে আজকের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় সাজসাজ রব। লাইটিং, পোস্টার, প্ল্যাকার্ডে রঙিন হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বর্ণাঢ্য আয়োজন আর ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের ৭০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে বলে জানান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসবেন আওয়ামী ও যুবলীগের অনেক নেতা। কারণ, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনের নেতাকর্মীরাই পরে জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতির হাতেখড়িও ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ থেকে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটি উৎসবমুখর করতে এবার নেয়া হয়েছে নানান প্রস্তুতি ও কর্মসূচী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজধানীর বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে আঁকা হয়েছে সাত দশকের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-‘বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস’। এসব ছবিতে ছাত্রলীগের ইতিহাস আর সরকারের সমকালীন অর্জনগুলো তুলে ধরা হয়েছে। দেয়ালচিত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবিসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গণতন্ত্রের আন্দোলনে ভূমিকা তুলে ধরতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা অধিকার আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সংগঠনের সোনালি অর্জনও তুলে ধরা হয়েছে। রাজধানীবাসীর ভোগান্তি এড়াতে রেওয়াজ ভাঙ্গছে ছাত্রলীগ ॥ রেওয়াজ অনুযায়ী প্রতিবছর ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে র‌্যালি করা হয়। রাজধানীবাসীর ভোগান্তি এড়াতে এবার সেই রেওয়াজ ভাঙ্গছে ছাত্রলীগ। অনুষ্ঠানের দিনটি বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস হওয়ায় রাজধানীবাসীর ভোগান্তি এড়াতে র‌্যালি ৪ জানুয়ারির পরিবর্তে ৬ জানুয়ারি করা হবে। রাজধানী ছাড়া দেশের অন্য সকল ইউনিটে আনন্দ র‌্যালি করা হবে বলে জানান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ৪ জানুয়ারি আমাদের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। রেওয়াজ অনুযায়ী আমরা ওই দিন র‌্যালি দিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু এবার জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রাজধানীবাসীর ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে র‌্যালি সাপ্তাহিক ছুটির দিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ জাতির পিতা সবকিছু সাধারণ মানুষের জন্য করেছেন। সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অন্যান্য কর্মসূচী নির্ধারিত সময়ে পালন করা হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, গত ২৪ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার নির্দেশে ভোগান্তি এড়াতে কথা দিয়েছিলাম সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ছাত্রলীগের কর্মসূচীগুলো পালন করব। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আমরা নেত্রীর সেই কথা পালন করেছি। প্রতিষ্ঠার দিনকে উৎসবমুখর করতে নয়টি উপকমিটি করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে বলে জানান ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ। তিনি বলেন, নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গঠন ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক আসবে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী থেকে। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে জঙ্গী ও অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের আহ্বান থাকবে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচী ॥ এবারের ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে থাকছে বর্ণাঢ্য কর্মসূচী। কর্মসূচীগুলোর মধ্যে রয়েছে- ৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬ টায় ছাত্রলীগের সকল সাংগঠনিক কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সাড়ে ৭ টায় জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন। সকাল ১০ টায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কার্জন হলে কেক কাটা। ৫ জানুয়ারি শুক্রবার রাজধানীসহ সারাদেশে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস পালন করবে ছাত্রলীগ। ৬ জানুয়ারি সকাল ১০ টায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পর্যন্ত আনন্দ র‌্যালি অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশ নেবেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ এবং রাজধানীতে অবস্থিত ছাত্রলীগের সকল ইউনিটের নেতা-কর্মী। ৮ জানুয়ারি সোমবার দুপুর ২ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, ৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী এবং ১১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বেলা ১০ টায় অপরাজেয় বাংলায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হবে। ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক দেলোয়ার শাহজাদা স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। ছাত্রলীগের কর্মসূচী ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন জানান, এবার দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম ছাত্রলীগের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন ছাত্রলীগ ঢাকার শহরে কোন আনন্দ র‌্যালি করবে না। ভবিষ্যতেও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আমাদের ১৭ হাজার নেতাকর্মী কেবল মুক্তিযুদ্ধেই আত্মাহুতি দিয়েছেন। ছাত্রলীগ সবসময় অপশক্তির বিরুদ্ধে। এ সংগঠন শুধুমাত্র ছাত্রসমাজের নয়, দেশের ১৬ কোটি মানুষের। কারণ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমরা সদা জাগ্রত। জাসদ ছাত্রলীগ আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে ॥ এদিকে মতাদর্শিক কারণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অপর একটি অংশ (জাসদপন্থী) আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে। আজ বেলা ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবন চত্বরে ‘এক দেশ এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু কর’ এবং ‘ডাকসুসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দাও’ স্লোগানে সমাবেশ ও র‌্যালি করবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের জšে§র এক বছর আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। প্রতিষ্ঠাকালীন এর নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। পাকিস্তান আমলেই ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে ফেলা হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর নাম হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। প্রতিষ্ঠালগ্নে নাইমউদ্দিন আহম্মেদকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর আরমানিটোলায় ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে দবিরুল ইসলাম সভাপতি ও মোহাম্মদ আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাঙালীর ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, ’৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ পরিশ্রমে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশ্চিত, ’৫৮-এর আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, ’৬৬-এর ৬ দফা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া, ৬ দফাকে বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পাক-শাসককে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং বন্দী দশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি, ’৭০-এর নির্বাচনে ছাত্রলীগের অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ, স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অসামান্য অবদান রয়েছে। তবে সংগঠনটি চলার পথ অনেক ক্ষেত্রে কুসুমাস্তীর্ণও ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সংগঠনটি বড় ধরনের ভাঙনের কবলে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা তৎকালীন ছাত্রলীগের বেশ ক’জন শীর্ষনেতা সংগঠন ছেড়ে ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় জাসদ ছাত্রলীগ নামে আলাদা ছাত্র সংগঠনও গড়ে ওঠে, যা আজ ছাত্র রাজনীতির মাঠে সক্রিয়। এরপরও কয়েক দফায় ভাঙা-গড়ার কবলে পড়তে হয়েছে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে’।
×