ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উত্তরা ও পূর্বাচল খাল থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র সরবরাহ করে উলফা

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭

উত্তরা ও পূর্বাচল খাল থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র সরবরাহ করে উলফা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করার জন্য ঢাকার উত্তরা ও পূর্বাচলের খাল থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদগুলো আনা হয়েছিল। অস্ত্রের চালান দুটো আনার সঙ্গে সরকার বিরোধীরা এবং আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত। অস্ত্রগোলাবারুদগুলো ভারতের অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা সরবরাহ করেছিল বলে গোয়েন্দা ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর ধারণা। পূর্বাচল থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদগুলো ব্যবহৃত। অস্ত্রের চালানের সঙ্গে জড়িত এখন পর্যন্ত সাতজন গ্রেফতার হয়েছে। এরমধ্যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সর্বশেষ কাতার থেকে ইন্টারপোলের সহায়তায় গ্রেফতার হওয়া হৃদয়কে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি। গত বছরের ১৮ জুন রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল থেকে সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ৯৫টি ও ২ দেশীয় পিস্তল, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোবের ১৯২টি ম্যাগজিন, ১০টি ম্যাগজিন গ্লোক পিস্তল, ২৯৫টি এসএমজির (সাব মেশিন গান) ২৬৩টি ম্যাগজিন, ১০টি বেয়নেট, ১০৪টি ছোট সিলিন্ডার আকারের বুলেট তৈরির বক্স, নাইন এমএম (নয় মিলিমিটার) পিস্তলের ৮৪০টি তাজা বুলেট, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ২১৭টি তাজা বুলেট, অস্ত্র পরিষ্কার করার ১৮৮টি ক্লিনিং রড উদ্ধার হয়। ঢাকায় ইতোপূর্বে এতবড় অস্ত্রের চালান আর উদ্ধার হয়নি। এমন ঘটনায় সারাদেশে রীতিমত হৈচৈ পড়ে যায়। এরপর চলতি বছরের ২ জুন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানাধীন পূর্বাচল ৫ নম্বর সেক্টরের লেক থেকে ৬৯টি এসএমজি, ৫টি পিস্তল, ২টি রকেটলঞ্চার, একটি রকেটলঞ্চারের সেল, ৩০টি প্রোর্টেবল টাইমস ডিভাইস, ৫টি ওয়াকিটকি হ্যান্ডসেট, ৫০টি এসএমজি ম্যাগজিন, ১০টি পিস্তলের ম্যাগজিন, ৮২৫ রাউন্ড এসএমজির তাজা বুলেট, ৬৫০ রাউন্ড ৯ এমএম পিস্তলের গুলিসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধার হয়। বড় দুইটি অস্ত্রের চালান উদ্ধারের ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। পূর্বাচল থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার এহসান উদ্দিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, পূর্বাচলের অস্ত্রগোলাবারুদের চালান ধরা পড়ার ঘটনাটি খুবই চমকপ্রদ। পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) অস্ত্রগোলাবারুদের চালান উদ্ধারের কয়েক মাস আগে পুরনো ঢাকার জিন্দাপার্ক এলাকায় যান একটি মামলার তদন্ত কাজে। ইয়াবা সেবনকারী আসামি গ্রেফতারে অভিযান চালান একটি বাসায়। সেই বাসা থেকে ইয়াবা ও একটি অস্ত্রসহ শরীফ খান (৩৫) নামের একজন গ্রেফতার হয়। শরীফের তথ্যমতে অস্ত্রটির মালিক শাহীন হোসেন (৩৫) গ্রেফতার হয়। শাহীনের কাছ থেকে আরও অস্ত্র উদ্ধার হয়। শাহীন জানায়, এমন অস্ত্র আরও রয়েছে। পরবর্তীতে অস্ত্রসহ পর্যায়ক্রমে মোঃ রাসেল (২৩), শান্ত (১৮), মোঃ মুরাদ মিয়া (২৬) ও মোঃ সাব্বির (২০) গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় আরও আটটি অস্ত্র। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক পূর্বাচলের খাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধার হয়। প্রকাশিত হয় হৃদয়ের নাম। পরবর্তীতে হৃদয়কে গত ৫ ডিসেম্বর রাতে দোহা-কাতার থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার করে ঢাকায় আনা হয়। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই সিআইডি কর্মকর্তা জানান, অস্ত্রগোলাবারুদগুলোর ফরেনসিক টেস্ট করা হয়েছে। টেস্টে সেগুলো ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। অস্ত্রগুলো বিদেশে তৈরি। তবে সেই দেশের নাম নেই অস্ত্রগোলাবারুদের গায়ে। যা খুবই তাৎপর্য বহন করে। সাধারণত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বেনামী অস্ত্র ব্যবহারের নজির রয়েছে। এসব গোষ্ঠীগুলো বড় বড় অস্ত্রের চালান বেনামে এনে থাকে। যাতে কোন সন্ত্রাসী কর্মকা- চালালে কোন দেশ অস্ত্র সরবরাহ করেছে, তার প্রমাণ না থাকে। এতে করে অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ নিরাপদে থাকে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের বড় চালানটির সঙ্গে বিভিন্ন র‌্যাঙ্ক ব্যাজ উদ্ধার হয়েছে। সেগুলো পার্শ্ববর্তী একটি দেশের বিছিন্নতবাদী সংগঠনের বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নানা কারণে ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর চরম অসন্তুষ্ট। ধারণা হচ্ছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি বিশাল অস্ত্রের চালানটি দেশে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরবরাহ করেছিল। অস্ত্রগুলো জঙ্গী সংগঠন ও তাদের সহযোগীদের হাতে পৌঁছানোর জন্য পূর্বাচলে জমা করা হয়েছিল। এই সিআইডি কর্মকর্তা বলছেন, উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদগুলোর সার্বিক তদারিকর দায়িত্ব ছিল হৃদয়ের। হৃদয়ের নির্দেশেই অস্ত্রগোলাবারুদগুলো বিচ্ছিন্নভাবে একেক জায়গায় এবং বিভিন্ন জনের কাছে রাখা হয়েছিল। কোথায় কার কাছে অস্ত্রগোলাবারুদগুলো হস্তান্তর করা হতো সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলছে। মূলত অস্ত্রগোলাবারুদগুলো পূর্বাচলের খালে মজুদ করা হয়েছিল। সেখান থেকে সেগুলো অন্যত্র স্থানান্তরের কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সেগুলো ধরা পড়ে যায়। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, উত্তরা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের পর সাঁড়াশি অভিযানে অস্ত্রগোলাবারুদসহ ৬২ জন জঙ্গী গ্রেফতার হয়। জঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদ আর উত্তরা ও পূর্বাচল থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদ এক ও অভিন্ন। অস্ত্রগোলাবারুদের চালান দুইটি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। আর অস্ত্রগোলাবারুদগুলো চীনের তৈরি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে অস্ত্রগুলো চট্টগ্রাম বন্দর না অন্যকোন সীমান্ত দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেছে তা জানা যায়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর উলফার তৎপরতা বন্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাঁড়াশি অভিযান চালায়। অভিযানের মুখে অনেক উলফা নেতা অন্যত্র চলে যায়। অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়ুয়াকে তার দুই সহযোগী লক্ষী প্রদীপ গোস্বামী ও বাবুল শর্মা, উলফা চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, সামরিক শাখার উপ-প্রধান রাজু বড়ুয়া, পররাষ্ট্র সচিব শশধর চৌধুরী, অর্থ সচিব চিত্রবন হাজারিকা, সংস্কৃতি সচিব প্রণতি ডেকা ও শীর্ষ নেতা পরেশ বড়ুয়ার পরিবারের সদস্যসহ অন্তত ৩১ জনকে ভারত সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করা ও ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের মুখে নিরাপদ আস্তানা ও নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ভেঙ্গে যাওয়ায় উলফা ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর ক্ষিপ্ত। তারই অংশ হিসেবে উলফা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকার বিরোধীদের কাছে অস্ত্রগোলাবারুদগুলো সরবরাহ করতে পারে। উদ্ধারকৃত বেয়োনেটগুলো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি সদস্যদের মধ্যে কমান্ডো নাইফ (গেরিলা চাকু) হিসেবে ব্যবহারের নজির রয়েছে। যা সরকার বিরোধীদের সঙ্গে উলফার যোগাযোগ থাকার বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়। উলফার একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার দুইজন ঘনিষ্ঠ সহচর বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি সদস্য। এছাড়া খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বিস্ফোরণ ও ভারতের মোস্টওয়ান্টেড এবং খাগড়াগড় বিস্ফোরণে অন্যতম হোতা বাংলাদেশী নাগরিক জেএমবির শীর্ষ নেতা হাতকাটা মাহফুজকে গ্রেফতারের পর ভারতীয় জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএর জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যই মিলেছে।
×