ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মরমী সঙ্গীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী আর নেই

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৫ নভেম্বর ২০১৭

মরমী সঙ্গীতশিল্পী  বারী সিদ্দিকী আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি আজ কেন হইলে নীরব মেল দুটি আঁখি, শুয়াচান পাখি আমি ডাকিত্যছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’ এ গানে দরদভরা সেই কণ্ঠ আর শোনা যাবে না। আর আঁখি মেলবেন না তিনি। স্তব্ধ হয়ে গেল তার সুর। চিরকালের ঘুমের জগতে চলে গেলেন মরমী সঙ্গীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী। বৃহস্পতিবার রাত দুটার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিল্পী বারী সিদ্দিকী (ইন্নালিল্লাহি... রাজেউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সঙ্গীতাঙ্গনসহ ভক্তদের মধ্যে। বারী সিদ্দিকীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যতদিন লোকসঙ্গীত থাকবে ততদিন বারী সিদ্দিকী বেঁচে থাকবেন। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে শুক্রবার সকালে বারী সিদ্দিকীর প্রথম নামাজে জানাজা হয়। এরপর তার মরদেহ ৩২ বছরের কর্মস্থল বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি জানাজায় অংশ নেয়া শিল্পী ও কলাকুশলীর মধ্যে ছিলেন ফকির আলমগীর, নকিব খান, শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, রবি চৌধুরী, মানাম আহমেদ, নোলক বাবু, পল্লব স্যান্নাল ও জালাল আহমেদ। এরপর নেত্রকোনা সরকারী কলেজ মাঠে বাদ আছর তৃতীয় জানাজা শেষে তাকে তার নিজের ‘বাউলবাড়ি’তে দাফন করা হয়। বারী সিদ্দিকীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা। তিনি বলেন, বারী সিদ্দিকীর হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুব ক্ষতি হয়ে গেলো। তার ইউনিক একটি ভয়েজ ছিল। গাওয়ার স্টাইলওটাও ছিল ভিন্ন রকম। তার গেয়ে যাওয়া গানের মধ্যেই তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। শিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, দেশে অনেক ডাক্তার আছেন, ইঞ্জিনিয়ার আছেন, শিল্পপতি আছেন, কিন্তু বারী সিদ্দিকী দেশে একজনই আছেন। সেই বারী সিদ্দিকী শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক কষ্টের, বেদনার। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বারী সিদ্দিকী একজনই। আমাদের সবাইকেই যেতে হবে। আর এ জন্য মানসিকভাবে আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়েজী বলেন, বারী ভাই আমাদের অনুভূতিকে ঋণী করে গেছেন, আমাদের হৃদয়কে ঋণী করে গেছেন। আমাদের অনুভূতি যতদিন থাকবে, আমাদের হদয় যতদিন থাকবে বারী ভাই ততদিন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। বারী ভাই আমার লেখা অসংখ্য গান গেয়েছেন। বারী ভাই আমার পরিবারেরই একজন। তার চলে যাওয়া আমার মেনে নেয়া অনেক কষ্টের, যন্ত্রণার। সঙ্গীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেন, বারী ভাই সত্যিকারের একজন ভাল মানুষ ছিলেন। এমন অসাধারণ কণ্ঠ আর আসবে না। তার প্রতিটি গানই একেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। কণ্ঠশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু বলেন, বারী চলে গেছেন, সম্পদ হারানোর মিছিলে বাংলাদেশ বিশাল এক সম্পদকে হারাল। বারী ভাইয়ের মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা আর কোনকিছু দিয়েই পূরণ হবার নয়। তার বাঁশি, তার কণ্ঠ দুয়ে মিলেই তিনি নিজেকে বারী সিদ্দিকী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। কয়েক জনমেও আর এই দেশে একজন বারী সিদ্দিকীর জন্ম হবে না। সঙ্গীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, সত্যিই বড় অসময়ে চলে গেলেন বারী ভাই। তার খুব বেশি যে বয়স হয়েছিল তেমন নয়। আরও বিশটি বছর অনায়াসে তিনি এদেশের সংস্কৃৃতির জন্য কাজ করে যেতে পারতেন। কিন্তু পারলেন না। তার পরিপূরক এই বাংলায় আর কেউ হবে না কোনদিন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বারী ভাইয়ের সুরে তিনটি গান গাইবার। আবার আমার সুরে ‘ঢাকা ড্রিম’ চলচ্চিত্রে তিনি প্লেব্যাক করেছেন। এটি আগামী বছর শ্রোতারা শুনতে পাবেন। সত্যি বলতে কি, বারী ভাই বাউলিয়ানা ছিলেন কিন্তু শেষ সময় ‘সেরা কণ্ঠ’তে ফোকগানের বিশেষ পর্বে যখন রাত আটটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত সময় কাটালাম তখন তারমধ্যে সংসার, সন্তান নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা দেখেছি। শিল্পী এ্যান্ড্রু কিশোর বলেন, চলমান ফোকসঙ্গীতে এক অন্যরকম ধারার সৃষ্টি করেছিলেন বারী ভাই। তার গায়কী, তার বাঁশি সবাইকে মুগ্ধ করত। এই অসময়ে চলে যাওয়াটা আসলে মেনে নেবার মতো নয়। ভীষণ খালাপ লাগছে বারী ভাইয়ের জন্য এই ভেবে যে তিনি যদি তার শরীরের প্রতি আরেকটু যতœবান হতেন তাহলে আমরা তাকে আরও বহু বছর পেতাম গানের ভুবনে। সঙ্গীতশিল্পী ঐশী বলেন, বারী স্যার চলে গেছেন, এটা বিশ্বাস করতেই আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি তার গান শুধু শুনতামই না মন দিয়ে অনুভব করতাম এবং এটা সত্য যে স্টেজ শো’তে বা টিভিতে কোন শোতে আমি তার গান দিয়েই শুরু করতাম। কয়েকদিন ধরেই তিনি স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। বারী সিদ্দিকীর দুটি কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি তিনি বহুমূত্র রোগেও ভুগছিলেন। ১৭ নবেম্বর রাতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। অচেতন অবস্থাতেই তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর তাকে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বারী সিদ্দিকী ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত বংশীবাদক। সে সঙ্গে তিনি ভাব ও মরমী ধারার এক অন্যরকম গায়কও বটে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গীত পরিচালক এবং একজন মুখ্য বাদ্যযন্ত্রী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নেত্রকোনায় ১৯৫৪ সালের ১৫ নবেম্বর বারী সিদ্দিকীর জন্ম। তার বাবা প্রয়াত মহরম আলী ও মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তার বাসায় যান বাঁশি বাজাতে। সেখানে বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও করেন তিনি। গান শুনে মুগ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৫ সালে বিটিভির ‘রং-এর বারৈ’ অনুষ্ঠানে প্রথম গান করেন বারী সিদ্দিকী। এর পরপরই হুমায়ূন আহমেদ তাকে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গান গাইতে বলেন। এই চলচ্চিত্রে ছয়টি গান করেন তিনি, যার প্রতিটিই বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান। বারী সিদ্দিকী ‘মাটির পিঞ্জিরা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ফেরারী অমিতের নির্দেশনায় ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। তবে অভিনয় করতেন নিতান্তই অনুরোধে এবং শখের বশে। নেত্রকোনায় বারী সিদ্দিকীর জানাজা ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা নেত্রকোনা থেকে জানান, শুক্রবার বাদ আছর (বিকেল ৪টায়) নেত্রকোনা সরকারী কলেজ মাঠে বারী সিদ্দিকীর তৃতীয় জানাজায় হাজারও মানুষের ঢল নামে। এতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মী, বারী সিদ্দিকীর ঘনিষ্টজন, সহপাঠী এবং সাধারণ এলাকাবাসী অংশ নেন। জানাজার আগে বারী সিদ্দিকীর বড় পুত্র সাব্বির সিদ্দিকী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল উপস্থিত জনতার উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। জানাজার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জেলা আওয়ামী লীগ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেলা পরিষদ, নেত্রকোনা পৌরসভা, জেলা বিএনপি, উদীচী, নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, প্রেসক্লাব, সিপিবিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বারী সিদ্দিকীর প্রতি শেষ শদ্ধা জানান। এরপর সন্ধ্যা ৬টায় নেত্রকোনা সদর উপজেলার কার্লি গ্রামে তার চতুর্থ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে কার্লি গ্রামে বারী সিদ্দিকী নির্মিত ‘বাউল বাড়িতে’ তার দাফন সম্পন্ন হয়। প্রসঙ্গত, বারী সিদ্দিকীর পৈত্রিক নিবাস নেত্রকোনা সদর উপজেলার মৌগাতি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামে। সঙ্গীত জীবনে প্রতিষ্ঠা অর্জনের পর তিনি কার্লি গ্রামে ‘বাউল বাড়ি’ নামে এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। তার মৃত্যুতে নেত্রকোনার সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সন্ধ্যা ৬টায় জেলা শহরের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্থানীয় শহীদ মিনারে প্রদীপ প্রজ্বলন কর্মসূচী পালন করে। দিনে ৩ কাপ কফি পান ক্ষতিকর নয় দিনে তিন থেকে চার কাপ কফি পান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই বরং তা বেশ উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই তথ্যটি এই কারণে তাৎপর্যপূর্ণ যে, সারাবিশ্বে প্রতিদিন দুই শ’ কোটিরও বেশি কাপ কফি পান করা হয়। এর আগে পরিচালিত এক গবেষণায় কফি পানের সঙ্গে লিভার (যকৃত) রোগের যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছিল। লিভারের কার্যকরী ক্ষমতা ও অবস্থা সম্পর্কে গবেষক দলের আগ্রহ ছিল বরাবরের। এক অস্ট্রেলীয় গবেষক দল এ সংক্রান্ত দুটি পরিসংখ্যান বিচার বিশ্লেষণ করে। প্রথমটি কফি পানের সঙ্গে যকৃতের স্থায়ী রোগের সম্পর্ক এবং দ্বিতীয়টি কফি পান ও যকৃত ক্যান্সারের যোগসূত্র। তবে আশাপ্রদ খবর যে, উভয় ধরনের গবেষণায় দেখা যায়, যারা খুব বেশি পরিমাণ কফি পান করেন তাদের জন্য উপরোক্ত দুটি ক্ষেত্রে নি¤œœতর পর্যায়ে ঝুঁকি থেকে যায়। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, কফি পানের ফলে ক্ষতির চেয়ে উপকারের পাল্লাই বেশি ভারি। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিদিন তিন থেকে চার কাপ কফি স্বাস্থ্যের জন্য বেশ সুফল বয়ে অনে। এসবের মধ্যে হৃদরোগ ও অন্যান্য মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ রোগের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দৈনিক তিন থেকে চার কাপ বা তারও বেশি কফি পান কখনও কোন ক্ষতির কারণ হয় না বরং এর উপকারের মাত্রা বেশি কিন্তু এটি নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। তবে কফিকে একেবারে নির্দোষ পানীয় বলা ভুল হবে। অতিমাত্রায় কফি পান টাইপ-২ ডায়াবেটিস, বিপাকীয় জটিলতা, মূত্রনালী পাথর ও গেটে বাতের ক্ষেত্রে স্বল্পমাত্রার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মহিলাদের অতিরিক্ত কফি পানে গর্ভস্থ সন্তানের ওজন হ্রাস, নির্দিষ্ট, সময়ের আগেই সন্তান প্রসব এবং গর্ভপাতের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তবে যারা নিয়মিতভাবে কফি পান করেন তারা যদি স্বাভাবিক পরিমাণে এটি গ্রহণ করতে থাকেন তবে ক্ষতির চেয়ে উপকারই বেশি। কিন্তু এক্ষেত্রে গবেষকগণের একটি সতর্ক পর্যবেক্ষণ হচ্ছে যে, তারা কফি সম্পর্কেই তাদের গবেষণা সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কফির সঙ্গে মিশ্রিত চিনি, নাস্তা হিসেবে গৃহীত বিস্কিট, কেক, পেস্ট্রির কোন প্রভাব সম্পর্কে তারা তাদের মতামত দেননি। বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে।
×