ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খাতুনগঞ্জ চাক্তাইয়ে চালের বাজার নিম্নমুখী

মনিটরিংয়ের অভাবে খুচরা পর্যায়ে সুফল মিলছে না

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৩১ জুলাই ২০১৭

মনিটরিংয়ের অভাবে খুচরা পর্যায়ে সুফল মিলছে না

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধির সাম্প্রতিক যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন সম্পূর্ণ নি¤œমুখী। এ নিঃমুখী দর পাইকারি বাজারে। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে ভোক্তাদের কাছে এর সুফল এখন পুরোপুরি মিলছে না। এর মূল কারণ হিসেবে আমদানিকারক ও চাল বিক্রেতাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে আছে। বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা বলবৎ করা না গেলে সরকার চালের আমদানির ক্ষেত্রে যে ১৮ শতাংশ শুল্ককর হ্রাস করেছে তাতে প্রকৃত ভোক্তা পর্যায়ে ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে না। শুল্ককর হ্রাস করার পর ইতোমধ্যে যে ৫ লাখ টন চাল বেসরকারী পর্যায়ে আসা পাইপ লাইনে রয়েছে এতেই সরকারের আড়াই শ’ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আয় কম হবে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। আর সরকারী পর্যায়ে যে ১২ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত হয়ে তা আসতে শুরু করেছে এতে ভর্তুকির পরিমাণ হিসাব করলে রাজস্ব আয় ব্যাহত হওয়ার ক্ষেত্রে তা তিনগুণ বেশি ছাড়িয়ে যাবে। আমদানির পরিমাণ যতই বাড়বে রাজস্ব আয়ের প্রক্রিয়ায় আর্থিকভাবে আরও ব্যাহত হতে থাকবে। সঙ্গত কারণে জনস্বার্থে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জরুরী ভিত্তিতে বলবৎ করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। এ দাবি খাতুনগঞ্জের ট্রেড এ্যাসোসিয়েশন ও চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির। বাজার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকে যে টন টন চাল আমদানি হয়ে আসছে তা শুধু সাময়িক নয়। বছরজুড়ে মূল্য বৃদ্ধির কোন আশঙ্কাও নেই। দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকদের সূত্রে জানানো হয়েছে, গত এক মাসেরও বেশি সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে চালের মূল্য বৃদ্ধির সূচনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ অর্থাৎ চাল আমদানিতে শুল্কহার ১৮ শতাংশ হ্রাস করায় এতে ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটেছে। এর পাশাপাশি সরকারী পর্যায়ে ১২ লাখ এবং বেসরকারী পর্যায়ে প্রায় ৫ লাখ টন চাল আমদানি শুরু হয়ে বন্দরে খালাস হতে থাকায় বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রতি কেজি বা বস্তায় চালের দাম হ্রাস পেতে শুরু করে। এতে মজুতদাররা সুবিধা করতে পারেনি। উপরন্তু যারা বাড়তি মুনাফার আশায় মজুদ করেছিল তারা লোকসান গুনছে। সরকারী পর্যায়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানির তিনটি চালান ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছার পর খালাস কাজও সমাপ্তির পথে। এর পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ের আমদানির চালও ক্রমাগত আসছে। মাঝপথে টানা ভারি বর্ষণের কারণে বহির্নোঙ্গর থেকে লাইটার জাহাজে ডেলিভারি কার্যক্রম ব্যাহত হলেও বর্তমানে তা জোরালোভাবে চলছে। এতে করে চালের বাজারগুলোতে সঙ্কট যেমন নেই, তেমনি মূল্যের ক্ষেত্রেও হ্রাস পেয়েছে। আমদানিকারকদের সূত্রে জানা যায়, মূলত ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভারত থেকেই আমদানির চাল সরকারী এবং বেসরকারী উভয় পর্যায়ে আসছে। ইতোপূর্বে চাল আমদানিতে সব মিলিয়ে শুল্ককর ছিল ২৮ শতাংশ। গেল মাসে সরকার এ হার ১৮ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশে নির্ধারণ করে দেয়। ফলে চালের বাজারে মূল্যের উর্ধগতি থমকে যায়। এর পরবর্তী সময়ে আমদানির চাল আসতে শুরু করায় বাজারে মূল্য হ্রাস পেতে থাকে। বস্তাপ্রতি ২শ’ থেকে আড়াই শ’ টাকা এবং ক্ষেত্র বিশেষে কেজিপ্রতি মূল্য কমেছে। তবে পাইকারি আড়তে যে দর কমেছে এর সুফল এখনও খুচরা বাজারে ব্যাপকভাবে প্রতিফলন ঘটেনি। তবে আশা করা হচ্ছে, ইতোপূর্বে যারা চড়ামূল্যে চাল ক্রয় করে রেখেছিল তা বাজারে ছেড়ে দেয়ার পর এর ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আসবে। তবে নতুন আমদানির চাল বাজারে আসার পর তা পাইকারি ক্রেতাদের কাছে বস্তাপ্রতি ২শ’ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। ভারত থেকে স্থলবন্দরগুলো দিয়ে প্রতিদিন ট্রাকে ট্রাকে চালের চালান আসছে। প্রধানত বেতি আতপ ও স্বর্ণ সিদ্ধ চালই আসছে। শুল্কহার কমানোর আগে বেতি আতপ চালের মূল্য যেখানে বস্তাপ্রতি ২১শ’ টাকা ছিল শুল্কহার কমানোর পর তা ১৮শ’ টাকায় নেমে এসেছে। অনুরূপভাবে আগে সিদ্ধ চাল আমদানিমূল্য ছিল বস্তাপ্রতি ২৪শ’ টাকা। আর এখন তা ২ হাজার থেকে ২০৫০ টাকায় নেমে এসেছে। খাতুনগঞ্জের চাল আমদানিকারকদের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকার চাল আমদানিতে শুল্কহার হ্রাস করার ঘটনাটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। অন্যথায় সর্বনি¤œ পর্যায়ের চালের দামও সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। অসাধু ব্যবসায়ীরা চালের উর্ধগতি লক্ষ্য করে মজুদ তৎপরতায় নেমে পড়ে। এন্টি হোড়িং আইন না থাকার কারণে মজুতদারদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন বা অন্য কোন সংস্থার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এতে করে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগটি বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক মহল আগেভাগে বিষয়টি টের পেয়ে চালের আমদানি শুল্ক হ্রাস করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা দিয়ে তা কার্যকর করে। এর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে তা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে খালাস হয়ে যাচ্ছে। সরকারী চালের পাশাপাশি বেসরকারী আমদানির চালও আসছে অহরহ। চট্টগ্রাম বœদরের বহির্নোঙ্গরে এমন কোনদিন নেই যেখানে প্রতিদিন কোন না জাহাজ থেকে চালের চালান খালাস হচ্ছে না। এসব চাল আমদানিকারকদের গুদামে পৌঁছুচ্ছে। পরে গুদাম থেকে চলে যাচ্ছে পাইকারি বাজারে। ফলে মূলত পাইকারি বাজারেই চালের মূল্য লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু খুচরা বাজারে গিয়ে তা এখনও ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়নি। ক্ষেত্রবিশেষে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত কমেছে। আমদানিকারকরা আশা করছেন, এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে খুচরা পর্যায়েও ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। এছাড়া ন্যূনতমপক্ষে বছরজুড়ে চালের বাজারে মূল্যের উর্ধগতির সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। খাতুনগঞ্জ ট্রেড এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহমদ ছগীর ও চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম রবিবার জনকণ্ঠকে জানান, বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা ছাড়া ভোক্তাদের জন্য চালের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনা সহজতর হবে না। প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা অবশ্যই চালু করতে হবে বলে তাদের দাবি। প্রসঙ্গত, এবারের বর্ষা মৌসুমে শস্য উৎপাদনের মাঠ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যথা সময়ে যা ফলন হওয়ার কথা এতে বড় ধরনের ধাক্কা আসে। অর্থাৎ, চালসহ বিভিন্ন ধরনের শস্যের উৎপাদন নিশ্চিতভাবে ব্যাহত হয়ে গেছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় এনে সরকার চাল আমদানিতে নিয়মিতভাবে যে রাজস্ব আহরণ হয়ে থাকে তা থেকে ১৮ শতাংশ হ্রাস করে দিয়েছে। বিষয়টি একদিকে যেমন ইতিবাচক তেমনি সময়োপযোগী বলেও আমদানিকারক মহলে আলোচিত হচ্ছে। সার্বিকভাবে বাজার পরিস্থিতি উর্ধমুখী থেকে এখন নি‍ঃমুখী। এতে করে সাধারণ মানুষের যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকাংশে দূরীভূত হয়েছে। কিন্তু চালের মূল্য উর্ধমুখী থেকে নি‍ঃমুখী হওয়ার বিষয়টি এখনও আমদানি এবং পাইকারি বিক্রেতা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সাধারণ ভোক্তাদের কাছে এর সুফল এখনও না মেলায় জনমনে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রে জানানো হয়েছে, চাল আমদানির ক্ষেত্রে এবার তারা বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে। আর এ বঞ্চিত হওয়ার বিপরীতে সুফল যদি সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছায় তাতে সার্বিকভাবে ১৮ শতাংশ শুল্ক হ্রাসের বিষয়টি প্রকৃত অর্থে কোন সফলতা বয়ে আনবে না।
×