ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় ॥ দ্বিতীয় খণ্ড ষষ্ঠ অধ্যায় দেশে ফিরে পশ্চিম পাকিস্তানে পদায়ন (গতকালের পর) কেন্দ্রীয় জনপ্রশাসন সচিব মোহাম্মদ আজফর (আমার প্রাক্তন পৃষ্ঠপোষক) আমার পদায়ন করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি আমার ভালর জন্যই এই পদে নিযুক্তি দিয়েছেন। আমি করাচীতে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে উপসচিবের কোন পদে নিযুক্ত হব। আমি তকে জানালাম যে করাচীতে যেতে আমার কোন আপত্তি নেই তবে আমার শারীরিক কারণে দু’মাসের ছুটি দরকার। তিনি বললেন তাতে কোন অসুবিধা হবে না তবে আমি যেন পরিকল্পনা সচিব সৈয়দ এএফএম আবদুস সুবহানের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ করি। আমি সুবহান সাহেবকে ফোনে সহজেই পেয়ে গেলাম। তার দুশ্চিন্তা ছিল যে আমি তদ্বির করে আমার পদায়ন বাতিল করে দিতে পারি। সে সময় বাঙালী কর্মচারীরা প্রায়ই কেন্দ্রীয় সরকারে বা পশ্চিমে যেতেন না। আমি তাকে নিশ্চিত করলাম যে আমি করাচীর পদায়নে বেশ খুশি তবে আমার কঠোর অসুস্থতার কারণে আমাকে একটু দেরি করে ভ্রমণ করতে হবে। আমার ছয় সপ্তাহের জন্য ছুটি মঞ্জুর হলো এবং আমি ক’দিন পরে সিলেটে বাড়ি গেলাম। সিলেটে কয়েকদিন যেতে না যেতে হঠাৎ আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আব্বা কিছু প্রাথমিক হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে তাকে কয়েকদিন থাকতে হলো এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরেও তার দুর্বলতা রইল প্রকট। আমি ব্যবস্থা করেছিলাম যে আমরা নৌপথে করাচী যাব। আল শামস নামে একটি উৎকৃষ্ট জাহাজ তখন সাত দিনে চট্টগ্রাম থেকে করাচী পৌঁছত। নৌপথে গেলে পদে যোগদানের সময় অনেক বেশি ছিল। অবশেষে ৭ নবেম্বরে আমরা সিলেট থেকে চট্টগ্রামে গেলাম এবং সম্ভবত দুদিন পর করাচীর পথে রওনা হলাম। চট্টগ্রামে আমার ভ্রাতৃসম ইনাম আহমদ চৌধুরী তখন ছিল অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। সে ও তার স্ত্রী নাগিনা আমাদের অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে দেখভাল করে। আল শামস জাহাজটি আনকোরা নতুন, প্রথম শ্রেণীর যাত্রী খুব কমই ছিলেন, তাই আমরা সবিশেষ সেবা পেতে থাকি। আমার ভয় ছিল যে আমার স্ত্রী পুরোপুরি সুস্থ হননি এবং এর আগে কোন দিন সমুদ্র যাত্রা করেননি। তাই তিনি যে ঝবধ ঝরপশ হতে পারেন সেই চিন্তায় আমি বেশ বিচলিত ছিলাম। যাই হোক, তার কোন ঝবধ ঝরপশহবংং হলো না বরং সামুদ্রিক হাওয়া হলো তার জন্য টনিক। আমাদের ভ্রমণটি ছিল খুবই আনন্দদায়ক। কলম্বোতে আমরা থামলাম কিন্তু জাহাজ থেকে নামলাম না। যথাসময়ে করাচীতে সম্ভবত এক সকালেই পৌঁছলাম। নৌবন্দরে আমাদের নেয়ার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের লোকজন ছিল। ছিলেন নাসির দম্পতি এবং আরও দুয়েকজন বন্ধুবান্ধব। আমরা গার্ডেন রোডে সরকারী কর্মচারীদের হোস্টেলে একটি কামরায় উঠলাম। সে সময় এই হোস্টেলেই ছিলেন আমার দাদা বিচারপতি এএসএম আকরাম। তিনি অবসরান্তে একটি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি আমাদের সম্ভাষণ করে বললেন যে আমাদের খাওয়া-দাওয়া হবে তার সুইটে। তিনি বললেন, করাচী হলো ভেজালের দেশ। এখানে খাবার তেলে মোবিল মিশিয়ে দেয়। তিনি লাহোর থেকে খাঁটি ঘি, তেল এসব নিয়ে আসেন এবং তার নিজের বাবুর্চি ভাল নির্ভেজাল খাবার পরিবেশন করে। তিনি যে ক’দিন হোস্টেলে ছিলেন তখন আমরা তার অতিথি হিসেবেই খাওয়া-দাওয়া করি। করাচীতে আমার চাকরি হলো পরিকল্পনা কমিশনের প্রশাসন বিভাগের উপসচিব। আমার সচিব সুবহান সাহেব বললেন যে পরিকল্পনা কমিশন এতদিন একটি অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান ছিল তাই এই বিভাগে যারা চাকরি করেন তারা প্রায় সবাই সাময়িকভাবে নিযুক্ত কর্মচারী। এখন এই বিষয়টি কীভাবে নিষ্পত্তি করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন ও ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মধ্যে আলোচনা চলছে। এই বিষয়টি নিষ্পত্তি করে সব কর্মচারীদের স্থায়ী পদে নিযুক্ত করতে হবে। অতঃপর আমাকে কমিশনে প্রোগ্রামিং বিভাগে প্রধান (চীফ) নিযুক্ত করা হবে। তিনি আরও বললেন যে তিনি বেশ অসুস্থ। তবে কমিশনে একজন অতিরিক্ত সচিব আছেন সুতরাং কোন অসুবিধা হবে না। অতিরিক্ত সচিব মুজফর আহমদ ছিলেন একজন সিন্ধি কর্মকর্তা এবং তিনি আমাকে জানালেন যে আমি সরাসরি তার অধীনে কাজ করব। বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমাকে জানালেন যে আমার কাছে একটি গাড়ি সার্বক্ষণিকভাবে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হবে এবং আমার সব রকম প্রয়োজন মেটাতে এমন কি বাজার করতেও তাকে পাওয়া যাবে। তাকে মনে হলো খুব স্মার্ট কর্মকর্তা যদিও তিনি কোন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ছিলেন না এবং কেরানি থেকেই পদোন্নতি পেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (অফসরহরংঃৎধঃরাব ঙভভরপবৎ) হয়েছেন। আমি বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় কোন গাড়ি আমদানি করিনি। আমার ধারণা ছিল আমি ফিরে আসলে কোন জেলায় প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হব। ইতোমধ্যে আমার জুনিয়র কয়েকজন জেলা প্রশাসক হিসাবে কাজ করছিল। কেন্দ্রীয় সরকারে বদলি হওয়ার ফলে আমার প্রথম চিন্তা হলো একটি গাড়ি খরিদ করা। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম যে ঢাকায় আমি সহজেই একটি নতুন গাড়ি খরিদ করতে পারি। তাই আমি সেই পন্থাই গ্রহণ করলাম। শিল্প বিভাগের মহাপরিচালক সানাউল হক সাহেব আমাকে একটি ঠড়ষশং ডধমড়হ গাড়ি কেনার বরাদ্দপত্র দিলেন। আমি এই গাড়িটি প্রায় নয়/দশ হাজার টাকায় খরিদ করে জাহাজে চট্টগ্রাম থেকে করাচীতে পাঠিয়ে দিলাম। মাসখানেকের মধ্যে আমার গাড়ি চলে এলো। কিন্তু বাড়ি বা এ্যাপার্টমেন্ট পাওয়ার ব্যাপারে কোথাও আশার বাণী শুনলাম না। গৃহায়ণ বিভাগে একজন বাঙালী উপসচিব ছিলেন খালেক সাহেব এবং তার উগ্র মেজাজের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। আমি তাকে একদিন টেলিফোন করলাম। তিনি বললেন যে তিনি আমার দরখাস্ত পেয়েছেন এবং বাড়ির জন্য খোঁজ করছেন। ক্লিফটন এলাকায় কোন বাড়ি খালি নেই তাই আমি যদি এ্যাপার্টমেন্টে যেতে রাজি থাকি তাহলে হয়ত দ্রুত কোন এ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যেতে পারে। তার কথাবার্তায় আমি কোন উগ্রতার নিদর্শনই পেলাম না। এর মধ্যে সরকারী হোস্টেলে একতলায় অবস্থিত একটি সুইট খালি হলো। (এ রকম সুইট ছিল মোট চারটি) এছাড়া আরও কিছু সুইট ছিল কিন্তু সেগুলো তেমন ভাল ছিল না। এই খালি সুইটের জন্য প্রার্থী ছিলাম আমরা দুই বাঙালী আমি এবং দিনা লায়লার আব্বা। সুইটটি আমার নামেই বরাদ্দ হলো এবং আমরা সেখানে প্রায় পাঁচ মাস বসবাস করি। সুইটে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা ছিল ভাল এবং কামরা ছিল দুটি যদিও বেশ ছোট। সবই ভাল ছিল কিন্তু তেলাপোকা ছিল অনেক। তেলাপোকা মারতে ওষুধ দিলে পাওয়া গেল প্রায় এক বালতি তেলাপোকা। এই নিধনযজ্ঞের পরেও কিন্তু তেলাপোকার অত্যাচার ছিল সরকারী হোস্টেলের বিশেষত্ব। দিনা লায়লা তখন করাচীর একজন জনপ্রিয় গায়িকা। একদিন ক্লিফটন এলাকায় একটি পার্কে একটি অনুষ্ঠানে দিনার ছোট বোন রুনাও গান করল, তখন থেকে রুনারও সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাদের পিতা মুজফর আহমদ ছিলেন শুল্ক বিভাগের কালেক্টর বা ডেপুটি কালেক্টর। আমি জানতে পেলাম যে তিনি সুইটটা না পাওয়ায় বেশ অসন্তুষ্ট। আমি তাকে একদিন টেলিফোন করে বললাম যে, আমাদের তো পরিচয় নেই তাই আমরা সেদিন বিকেলে তাদের এ্যাপার্টমেন্টে যাব। সেদিনই তার ও তার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হলো। তার কাছে জানলাম যে তিনি ফরিদপুরের মানুষ। তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো এবং আমার মনে হলো তার ক্ষোভও প্রশমিত হলো। কিছুদিন পরে আমরা গার্ডেন রোডে এ্যাপার্টমেন্টে চলে গেলে তারাই আমাদের পরিত্যক্ত সুইটে স্থানান্তরিত হন। করাচীতে তখন বাঙালী সরকারী কর্মচারীদের সংখ্যা ছিল খুব কম। অনেকেই তখন রাওয়ালপিন্ডি বা ইসলামাবাদে চলে গিয়েছিলেন। আমরা যারা তখন পর্যন্ত করাচীতে ছিলাম তারা মাঝে মাঝেই টেলিফোনের ডাকে সমবেত হতাম। কারো বদলি হলে বা কারও কোন খুশির কিছু থাকলে সকলে মিলে চা খাওয়া ছিল একটি নিয়মিত রেওয়াজ। আমি ভাবলাম আমরা নতুন কিছু করতে পারি, একটি ছুটির দিনে পিকনিক করতে পারি। পরিকল্পনা কমিশনেই ছিল বাঙালী কর্মচারীদের প্রায় সর্ববৃহৎ অংশ। এ ছাড়া জাতীয় পরিষদের সচিবালয়ে বেশকিছু বাঙালী কর্মচারী ছিলেন। তাই আমরা একটি সমুদ্র বিচে পিকনিকের ব্যবস্থা করলাম। ছাগল পাওয়া গেল সেনাবাহিনীর সরবরাহ বিভাগের একজন কর্মকর্তার আগ্রহে। বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা খায়রুননেসা বেগমও এই পিকনিকে শরিক হলেন। পরিকল্পনা কমিশনের মাসুদ সাহেবের মেধাবী একটি ছেলেও এই পিকনিকে সম্মানিত হলো। সমুদ্র তীরে পিকনিকটি অনুষ্ঠিত হওয়ায় করাচীর ভ্যাপসা গরমেও আমাদের আনন্দানুষ্ঠান বিঘিœত হলো না। আমি জানি না এ রকম পিকনিকের রেওয়াজটি কি বহাল ছিল? আমি পরবর্তী বছরে ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসেই রাওয়ালপিন্ডিতে বদলি হয়ে চলে গেলাম। চলবে..
×