ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাট্যচর্চায় ভাটা

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নাট্যচর্চায় ভাটা

সংস্কৃতির শেকড় ময়মনসিংহে হারিয়ে যেতে বসেছে আবহমান গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যের মূল ঢংয়ের যাত্রাপালা ও মঞ্চ নাটক। অশ্লীলতার দাপটে কদর কমে গেছে যাত্রাপালার শিল্পীদের। সিনেমা হলে বোমা হামলার পর থেকে কমে গেছে নাট্যচর্চা ও মঞ্চায়ন। নানা হতাশায় আর অর্থাভাবে শিল্পীদের অনেকে পেশা বদল করেছে। আর এখনও যারা এই পেশা আঁকড়ে রয়েছে তাদের অমানবিক দিন কাটছে। নেশা থেকে পেশায় আসা এক সময়কার তারকা যাত্রা শিল্পীদের হতাশা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। একই অবস্থা নাট্য শিল্পীদেরও। অধ্যাপক সুধীর দাস রচিত ময়মনসিংহের নাট্য পরিক্রমা থেকে জানা যায়, এক সময় কলকাতা ছিল বঙ্গ সংস্কৃতির কেন্দ্র। এই কলকাতাতেই প্রথম বাংলা নাট্যশালা স্থাপিত হয়েছিল। পরবর্তীতে জমিদার ও ধনিক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় ময়মনসিংহে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ময়মনসিংহে অমরাবতী নাট্য সংস্থাসহ অসংখ্য নাট্য সংস্থা গড়ে ওঠে। নাটকের পাশাপাশি যাত্রা শিল্পেরও প্রসার ঘটে ওই সময়ে। ময়মনসিংহের গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, গফরগাঁওসহ অনেক পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠে পেশাদার যাত্রাপালার দল। একই সঙ্গে চলে নাটকের মঞ্চায়ন। এসব দল থেকে অনেক পেশাদার শিল্পী তৈরি হয়। এদের অনেকে পরে তারকা শিল্পীর খ্যাতি অর্জন করে। হাবিব সারোয়ার তাদের একজন। আলাপচারিতায় এই যাত্রা শিল্পী জানান, নাটক চর্চায় ব্রিটিশ আমলে ময়মনসিংহ সদরের শম্ভুগঞ্জে গঠিত হয় মিলন সংঘ। চরঝাউগড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ক্ষীরোদ লাল সাহা ওরফে লেডু স্যার ছিলেন এই সংঘের কর্ণধার। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নেওয়াজ আলী সরকার, হোসেন আলী সরকার, হান্নান ডাক্তারসহ অনেকে। মূলত লেডু স্যারের উদ্যোগেই ওই সময়ে হাতে খড়ি হাবিব সারোয়ারের। দেশ স্বাধীন হলে মিলন সংঘের নাম হয় তরুণ সংঘ। এখান থেকে চরহরিপুরের মফিজ, সিদ্দিকসহ অনেক শিল্পী তৈরি হয়। আশির দশকের গোড়ার দিকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে যখন নাটক মঞ্চায়ন আর যাত্রা শিল্পের রমরমা অবস্থা, তখন ময়মনসিংহ সদরের চুরখাই এলাকার জাগরণ অপেরার মধ্য দিয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন হাবিব সারোয়ার। পালায় নায়ক হিসেবে হাবিরের পথচলা শুরু। অশ্রু দিয়ে লেখা, বাগদত্তা, নিচু তলার মানুষ, একটি পয়সাসহ অন্তত ২শ’ যাত্রাপালায় নায়কের অভিনয় করেন হাবিব। এখনও প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন। বিদগ্ধ এই শিল্পী জানান, এক সময় দুর্গাপূজ, অষ্টমী ¯œানসহ শীত মৌসুমে গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালার প্রতিযোগিতা হয়েছে। হাট-বাজারে চাঁদার টাকায় এসব পালা হতো। শহর ও গ্রামে হতো মঞ্চ নাটক। নেশা থেকে পেশায় আসা শিল্পীদের পাশাপাশি পেশাদার শিল্পীরাও নাটক ও যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। এ সময় গৌরীপুরে নবরঞ্জন অপেরা, শ্যামগঞ্জের সবুজ অপেরা, ঈশ্বরগঞ্জের সোহাগীতে বুলবুল অপেরা, গফরগাঁওয়ে মিতালী অপেরা, মোহনগঞ্জে নবযুগ অপেরাসহ অসংখ্য যাত্রাদলের সৃষ্টি হয়। গফরগাঁওয়ের আমির সিরাজী, সোহাগীর এমএ জব্বার, শালিহরের রমজান ভুইয়া, গৌরীপুরের এম আলীম ও নেত্রকোনার এমএ রহিমসহ অনেক খ্যাতিমান শিল্পীও তৈরি হয় এ সময়। ১৯৮৪ সালে বিটিভিতে হাবিব সারোয়ার অভিনীত দেবী সুলতানা প্রচারিত হলে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তার। সত্তর দশক থেকে নব্বইয়ের গোড়া পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলে যাত্রাপালার প্রদর্শন হয়েছে নিয়মিত। টাকার জন্য কেউ এই পেশায় না এলেও যাত্রা শিল্পীদের কদর ও আর্থিক সুবিধা ছিল। ময়মনসিংহ শহরের কৃষ্টপুর ও ব্রাহ্মপল্লী এলাকা থেকে নাটক ও যাত্রাপালার জন্য নারী শিল্পী সম্মানীর বিনিময়ে অভিনয় করেছে। এ জন্য পেশাদার নারী শিল্পীরও সৃষ্টি হয়। কিন্তু নব্বইয়ের পর থেকে যাত্রায় অশ্লীলতা এবং পেশাদার শিল্পীদের পেশা বদল শুরু হলে মন্দাভাব দেখা দেয় এই শিল্পে। ২০০৩ সালে ময়মনসিংহের চার সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলার পর থেকে নাটক মঞ্চায়নেও স্থবিরভাব বিরাজ করে। সম্প্রতি কিছু কিছু নাট্য সংগঠনের উদ্যোগে ফের নাটক হচ্ছে। এখন যারা লড়াই সংগ্রাম করে টিকে আছে তাদের অনেকে হতাশায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যাত্রা শিল্পীদের অভিযোগ- যাত্রার নামে এখন যা হচ্ছে সেটি অশ্লীলতায় ভরপুর এবং উলঙ্গ নৃত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন যাত্রাপালার জন্য কোন পেশাদার শিল্পীর প্রয়োজন পড়ে না। নৃত্য শিল্পী দিয়েই চালানো হচ্ছে সব পালা। এমনকি ব্যস্ত নগর জীবনে যাত্রাকে উপস্থাপন করা হচ্ছে বিকৃত ঢংয়ে। এতে যাত্রার প্রকৃত স্বাদ পায় না দর্শক। ফলে যাত্রা শিল্পের রমরমা অবস্থার সময় যেখানে দেশে দু’শ’র বেশি যাত্রাদল ছিল, এখন সেটি কমে ৫-৬টিতে দাঁড়িয়েছে বলে জানান হাবিব। তার মতে যাত্রা শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০১২ বাস্তবায়ন হলে আগের চেহারায় ফিরে আসবে ঐতিহ্যের যাত্রাপালা। Ñবাবুল হোসেন ময়মনসিংহ থেকে
×