ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দখল-দূষণ রোধে নদী রক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন দাবি বিশেষজ্ঞদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১০ জানুয়ারি ২০১৬

দখল-দূষণ রোধে নদী রক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন দাবি বিশেষজ্ঞদের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ধ্বংসের হাত থেকে দেশের নদ-নদী রক্ষা করতে জরুরী ভিত্তিতে নদী রক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, নদীর সঠিক মালিকানা না থাকায় নদীগুলো বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। দখল-দূষণে মৃত প্রায়। সরকার নদী রক্ষায় একটি কমিশন গঠন করলেও তা কোন কাজে আসেনি। কারণ নদী রক্ষায় কমিশনের সুপারিশের বাইরে কিছু করার ক্ষমতা নেই। নদী রক্ষায় এখন সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া না হলেও ধ্বংসের হাত থেকে নদী রক্ষা করা যাবে না উল্লেখ করেন তারা। শনিবার দেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পরিবেশ নিয়ে দুদিনের সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে গত শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে শনিবার এ সম্মেলন শেষ হয়। পরিবেশ সংগঠন বাপা ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে। শেষ দিনে উপকূলীয় দ্বীপ, নদী ভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা দেশে কৃষি ব্যবস্থা চিংড়ি চাষসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়। আলোচনায় অংশ নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী তোফায়েল আহমেদ বলেন, নদীর মালিকানা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে বিরোধ রয়েছে। কোন সংস্থায় নদীর মালিকানা দায়িত্ব নিয়ে নদী রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। বিভিন্ন সংস্থার অনীহায় নদীগুলোর আজ করুণ অবস্থা হয়েছে। তিনি বলেন, নদীর জমি ইজারা দেয়ার নামে ঢাকার চার নদীর দখল বিভিন্ন জনের হাতে চলে গেছে। এখন তাদের হাত থেকে নদী জায়গা উদ্ধার করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। দখলে-দূষণে নদীর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, একবার কেউ বুড়িগঙ্গার ধারে গেলে দ্বিতীয়বার যেতে চায় না। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার চারটি স্থানে ব্যক্তি মালিকানার নামে নদী দখলে নদী সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। অথচ আইনে নদীর জায়গা ব্যক্তি মালিকানায় থাকার কথা নয়। ঢাকার চার নদীতে এসএ ম্যাপের পর মহানগর জরিপ কার্যকর থাকলেও অনেকে আরএস পর্চা দেখিয়ে নদীর জায়গা দখল করে রেখেছে। দখলকারীদের উচ্ছেদ করতে গিয়ে মামলার কারণে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এছাড়া সরকারী বিভিন্ন সংস্থা নদীর জায়গা দখল করে স্থাপনা গড়ে তুলেছে। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও আজ নদীতে পানি নেই। অথচ হিমালয় থেকে নেমে আসা পানির ৯০ ভাগ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আজ আমরা পানি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছি। ফলে গ্রাম অঞ্চলে পানির অভাবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পুকুর খাল বিলে সারাবছর পানি থাকছে না। খাদ্যের অভাবে গবাদিপশু ও প্রাণী বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। গ্রামীণ চাষাবাদ প্রকৃতি নির্ভরতা বাদ দিয়ে অনেকটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে। এ ধরনে চাষাবাদে ফসলের ফলন বৃদ্ধি পেলে দিন দিন মাটির উর্বতা শক্তি নষ্ট হয়ে পড়ছে। এক পর্যায়ে এসব মাটিতে আর কোন ফসল ফলবে না। এ কারণে চাষাবাদে সার কীটনাশকের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সৃষ্ট অভিঘাত, বৃষ্টিপাতের তারতম্য সাগরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত সৃষ্টি হচ্ছে পানি সেক্টরে। এছাড়া সমুদ্রের লোনা পানি দক্ষিণাঞ্চলকে এমনভাবে প্রভাবিত করছে যা গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য শতাব্দীর এক অভিশাপ হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে। লোনা পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সুস্বাদু পানির প্রবাহ উত্তর থেকে দক্ষিণে শুধু স্তিমিতই হচ্ছে না। বরং দক্ষিণের লোনা পানি গ্রাস করছে উত্তরের জেলাসমুহকে। ভোলা, বরিশাল, গোপালগঞ্জ যাশোর ইত্যাদি অঞ্চলের পানি ক্রমাগত লবণাক্ত হয়ে উঠছে। তারা বলেন, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা প্রভৃতি জেলায় ব্যাপকভাবে লবণ পানি প্রবেশ করিয়ে সংরক্ষিত ঘের নির্মাণ করে চলছে চিংড়ি চাষ প্রকল্প। কোথাও দুই-তিন বিঘা জমিতে চওড়া বাঁধ দিয়ে আবার কোথাও ২/৩ একর এলাকায় বাঁধ দিয়ে ঘেরের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এসব ঘেরে সরাসরি নদী বা খাল সংযোগে লবণ পানি প্রবেশ করিয়ে বাগদার রেণু পোনা ছাড়া হচ্ছে। এ কারণে সারাবছরই ওই পানি বিলের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখছে। এই কৃত্রিম ক্ষতিকর লবণ জলাবদ্ধতার প্রভাব মারাত্মক পরিবেশ বিধ্বংসী রূপ গ্রহণ করছে। পরিবেশ বিষয়ক এ সম্মেলনে তারা উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বন ক্ষতি করে চিংড়ি চাষের সমালোচনা করে বলেন, কক্সবাজার জেলার মাতামহুরী ডেল্টায় চকরিয়া বনভূমির ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ২১ হাজার ম্যানগ্রোভ ক্ষতিগ্রস্ত করে চিংড়ি চাষের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাণী বৈচিত্রে ভরপুর চকোরিয়া বনভূমি আজ বিলুপ্তপ্রায়। গোটা বনভূমি আজ বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। সেনিমারের জানানো হয় সকলের সম্মিলত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের নদ-নদী রক্ষা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। ভূগর্ভ পানির পরিবর্তে নদীর পানি সমন্বিত ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করার আহ্বান জানানো হয়। তারা বলেন, প্রাকৃতিকভাবে সৃজিত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল নির্বিকারে যেভাবে নিধন করা হচ্ছে তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উপকূলীয় এলাকায় প্যারাবন রোপণ করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে নদ নদী ও উপকূলীয় এলাকায় ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এর কোন বিকল্প নেই। সমাপনী দিনে সার্বিক পরিবেশ রক্ষায় একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এতে বাপা সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বক্তৃতা করেন। এছাড়া দুদিনের এ সম্মেলনে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, গবেষক. বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকসহ বিভিন্ন সেক্টরের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।
×