
ঢাকার উপকন্ঠের রূপগঞ্জের তিন লাখ বাসিন্দা উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। আকাশে মেঘ জমলেই নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী সেচ প্রকল্পের ভেতরে বসবাসকারীদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এলাকার কোথাও জমেছে হাটু পানি। আবার কোথাও কোমর পানি। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তারাব পৌরসভায় কোটি কোটি বরাদ্দে পয়নিষ্কাশন খাল পরিষ্কার করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্থানীরা অভিযোগ করে বলছেন, বরাদ্দের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন পৌরসভার মেয়র হাসিনা গাজী। খাল সংস্কার করা হয়েছে লোক দেখানো।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানা যায়, ১৯৮৪ সালে ৯০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে নারায়রগঞ্জ-নরসিংদী অগ্রনী সেচ প্রকল্প-১ ও পরে ১৯৯৩ সালে ১’শ ১ কোটি ব্যয়ে শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ের ৫ হাজার হেক্টর জমি ঘিরে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মান করা হয় । নির্মাণ হওয়ার ক’বছর বাদেই এখানে শুরু হয় জলাবদ্বতা। জনবসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে দুর্ভোগও। স্থানীয়রা বলেন, ৯০ দশকের পর নিয়মবহিভূর্তভাবে অগ্রনীর ভেতরে মিল-কারখানা গড়ে উঠলে অগ্রনী পরিনত হয় আবাসিক ও শিল্প এলাকায়। সেই থেকে দুর্ভোগ চরমে উঠে মানুষের। বসতি আর কারখানার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফি-বছর বাড়ে জলাবদ্বতাও। একে এক ক্রটিপূর্ণ হয়ে পড়ে অগ্রনী সেচ প্রকল্পের খালগুলো। শিল্প মালিক ও এক শ্রেনীর হতকুচ্ছিত দানবের দল নিজ স্বার্থে খালগুলো ভরাট করে যথেচ্ছ ব্যবহারে এ সমস্যার সৃষ্টি করছে বলে এলাকাবাসী মনে করছেন। সেই যে শুরু, আর যেন এর শেষ নেই। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে এনএনআই প্রকল্পের অনেক এলাকা। ফলে দূর্ভোগ চরমে উঠেছে।সরেজমিনে দেখা গেছে, রূপগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার নিম্নাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
বরপা, তেতলাবো, মাসাবো, কান্দাপাড়া, কর্নগোপ, কাহিনা দৈবই, গন্ধবপুর, দীঘিবরাবো, খাদুন, মৈকুলী,হাটাবো, বারৈপাড়া, নবারুণ, কুশাব, পিঠা গুঁড়ি, আমলাবো,আউখাব, বলাইখা, টেলাপাড়া, পাচাইখা, ছোনাবো, মাসুমাবাদ, নতুন বাজার, বাঘমোছড়া, নাগেরবাগ, বউ বাজার, ৫ নম্বর ক্যানেল, বলায়া,গঙ্গনগর, দরিকান্দি, শিবগঞ্জ, মিরকুটিরছেও।
স্থানীয়রা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে একই সমস্যা চললেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা হলেও বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে দুর্ভোগকে মেনে নিচ্ছে। অনেকেই বলছেন, জলাবদ্ধতা যেন আমাদের নিয়তি হয়ে গেছে।নাগের বাগ এর আব্দুর রহমান বলেন, বৃষ্টি শুরু হলেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়। কোমর পানি পার হয়ে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতে হয়। দোকানে পানি, অফিসে পানি জীবনটা যেন থমকে যায়। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান নেই।
বরপা শান্তি নগর এর বাসিন্দা কাসেম ড্রাইভার বলেন, আমরা প্রায় প্রতি বর্ষায় পানির নিচে ডুবে থাকি। একটু বৃষ্টি হলেই শান্তি নগর শান্তিতে থাকে না। রাস্তা-ঘাট, ঘরের উঠান—সব জলে ভরে যায়। স্কুলগামী শিশু, অফিসগামী মানুষ, রোগী—সবাই ভোগান্তিতে পড়ে। আমি পেশায় ড্রাইভার, গাড়ি বের করাই মুশকিল হয়ে যায়। এই সমস্যা বছরের পর বছর চলছে। কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
মৈকুলী গ্রামের গৃহবধূ শামীমা আক্তার বলেন, কত বছর আগে যে আমাদের এলাকাটা ভালোভাবে শুকাইছিলো, সেটা আমি মনে করতে পারি না। এখানে বছরের আট-দশ মাসই পানি জমে থাকে। মিল-ফ্যাক্টরিগুলো আশেপাশের খাল দখল কইরা রাখছে, পানি যাওনের কোনো রাস্তা নাই। বৃষ্টি একটু বেশি হইলেই তো ঘরে পানি ঢুইকা যায়। আমরা তো গরিব মানুষ, কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই—এই কষ্টের মাঝেই থাকতে হয়। আল্লাহ চাইলে কোনো সময় শুকায়, না হইলে পানি আর যায় না। এভাবে থাকলে কয়দিন আর মানুষ থাকবে বলেন? আমাদের আশেপাশের অনেকেই তো বাড়িঘর বিক্রি কইরা চলে গেছে। আমরা টিকতে পারতেছি না, শুধু কষ্ট পাই। আমি কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল অনুরোধ করি দয়া করে খালগুলা দখলমুক্ত করেন, পানি যাইবার ব্যবস্থা করেন। গরিব মানুষরে আর কষ্টে ফালাইয়া রাখবেন না।
কর্নগোপের বাসিন্দা মাওলানা মাহাবুবুর রহমান বলেন কর্নগোপ এলাকার জলাবদ্ধতা আজ আর শুধু একটি মৌসুমি সমস্যা নয়, এটি এখন জনজীবনের স্থায়ী দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। প্রতি বর্ষায় কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টিই পুরো মহল্লা ডুবিয়ে দেয়। মসজিদে যেতে কষ্ট হয়, স্কুলে বাচ্চারা যেতে পারে না, এমনকি কবরস্থানে জানাজাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এটা শুধু অবকাঠামোগত ব্যর্থতা নয়, এটি মানবিক ও সামাজিক ব্যর্থতাও। আমি একজন ধর্মীয় মানুষ হিসেবে বলবো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু পানি জমে থাকার কারণে এলাকায় ময়লা-আবর্জনার গন্ধ, মশা-বাহিত রোগ, ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে। আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি একটি পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন। খাল-বিল দখলমুক্ত করে পানি চলাচলের পথ খুলে দিন। আমরা চাই না শুধু ওয়াদা, আমরা চাই বাস্তবিক পদক্ষেপ। কর্নগোপের মানুষ শান্তিতে বাঁচতে চায়, সেটা নিশ্চিত করাটা দায়িত্বশীলদের কর্তব্য।
মিরকুটিরছেও এলাকার বাসিন্দা জামিল ভূইয়া বলেন, বর্ষা আসলেই আমরা আতঙ্কে থাকি। রাস্তাঘাটে তো সবসময়ই পানি জমে থাকে, আর বৃষ্টি হলে সেই পানি ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরেও। খালের পানি কালচে হয়ে থাকে শোনা যায় কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য পানি মিশে যাচ্ছে। এই পানি শুধু অসুবিধা নয়, একেকটা রোগের উৎস হয়ে উঠছে, বিশেষ করে চর্মরোগ, এলার্জি, ঘা, চুলকানি লেগেই থাকে। আমরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, আমাদের কেউ দেখে না। কতবার কতজনের কাছে গেছি, কেউ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এখন শুধু আল্লাহর দিকেই তাকিয়ে আছি।
কলেজ ছাত্রী জান্নাতি আক্তার বলেন, অল্প বৃষ্টি হলেই প্রতিদিন পানির মধ্যে দিয়ে কলেজে যেতে হয়। কখনো কোমর পানি, কখনো হাঁটুর ওপরে উঠে যায়। বই-খাতা ভিজে যায় বলে খুব ভয় লাগে। সময়মতো পৌঁছাতে পারি না, ক্লাস মিস হয়ে যায়। অনেক সময় তো বেরই হতে পারি না। মেয়েদের জন্য এটা আরও বেশি কষ্টের পানি, কাদা, ভেজা জামাকাপড়ে দিনের শুরুটা যেন যুদ্ধের মতো।
রূপগঞ্জে উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন বলেন, খাল-বিল ভরাট হওয়া, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ও অচল পাম্পমেশিন এই তিনটি কারণেই মূলত জলাবদ্ধতা হচ্ছে। আপাতত আমরা নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছি জলাবদ্ধতা নিরসনে জন্য আশা করি যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করবো।
রূপগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি গত ১১ মাসে ৮টি খাল পুনরুদ্ধার করেছি। পাশাপাশি কয়েকটি খাল পুনঃখনন করেছি। ইস্ট ওয়েস্ট আবাসন কোম্পানি একটি পুরো খাল দখল করে ভরাট করেছিলো সেটি আমরা উদ্ধার করে আবার পুনরায় খনন করেছি। আমাদের এখানে একটি বড় গ্রুপ কোম্পানি -সিটি গ্রুপ একটি খাল দখল করে মাটি ভরাট করে রেখেছে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে কে পত্র দিয়েছি তারা কথা দিয়েছে আগামী মাসে উদ্ধার করে দিবে ।
অপরিকল্পিত নগরানের কারণে মূলত আরো বেশি জলাবদ্ধতা বেড়েছে । জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খনন ও ড্রেন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এটি সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়। দরকার একটি মাস্টারপ্ল্যান যাতে রূপগঞ্জের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা টেকসই হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক রাকিবুল আলম রাজিব বলেন, রূপগঞ্জে জলাবদ্ধতার মূল কারণ হলো এখানকার অধিকাংশ খাল দখল হয়ে গেছে। বিশেষ করে তারাবো পৌরসভার খালগুলো এখন নানা শিল্পগ্রুপের দখলে। সিটি গ্রুপ, গাজী গ্রুপ, অন্তিম নিট কম্পোজিট, মজুমদার গ্রুপসহ বেশ কিছু গ্রুপ কোম্পানি খালের স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে রেখেছে। এবং কাঞ্চন, ভুলতা, গোলাকান্দাইল এই সব এলাকায় আবাসন প্রকল্প ও সড়ক উন্নয়ন (চার লেন প্রকল্প) কাজের ফলে খালগুলো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফলে পানি বের হতে পারছে না, আর জলাবদ্ধতা এখন স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। এছাড়া বিগত সময়ে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার কারণে পাম্পগুলো নষ্ট থাকলেও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে বর্তমানে সেগুলো সচল করা হয়েছে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে চেষ্টা করছি দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধার করতে, যাতে স্বাভাবিক পানি নিস্কাশনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা যায়।
রাজু