ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

কী অবস্থা বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

প্রকাশিত: ১৯:১৮, ২৭ জুন ২০২৫

কী অবস্থা বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

ছবি: সংগৃহীত

সামরিক শক্তির বৈশ্বিক মূল্যায়নে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় দেশের সক্ষমতা নিয়ে দানা বেঁধেছে গভীর শঙ্কা। সামরিক শক্তি বিশ্লেষণকারী ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার-এর ২০২৪ সালের সর্বশেষ তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৩৫তম অবস্থানে। তবে সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতি, যেমন, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তানের আকাশভিত্তিক সংঘাতে বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষার দুর্বলতা নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

 

 

ইরান-ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধে ইরান ছুড়েছিল ৫৩২টি মিসাইল। এর মধ্যে মাত্র ৪২টি ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হানে। ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আয়রন ডোম, এরো ডিফেন্স ও ডেভিড’স স্লিং, বাকি ৯২% মিসাইলকে আকাশেই ধ্বংস করে দেয়। ইউক্রেনেও একইভাবে প্যাট্রিয়ট, আইআরআইএস-টি, ডেভিড’স স্লিং মিসাইল সিস্টেম কার্যকরভাবে রাশিয়ার মিসাইল প্রতিহত করেছে।

এশিয়ায়ও এ চিত্র ব্যতিক্রম নয়। ভারত এস-৪০০ ও ভারত-ইসরায়েল যৌথভাবে তৈরি বারাক-৮ সিস্টেম দিয়ে নিজ আকাশসীমা রক্ষা করছে। অথচ বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা এখনও অনেকটা সীমিত এবং দুর্বল।

 

বাংলাদেশের বর্তমান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত গঠিত যুদ্ধবিমান, ভূমি-থেকে-আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং রাডার প্রযুক্তির সমন্বয়ে। তবে এই ব্যবস্থার আধুনিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।

ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা:
  ২০১১ সালে কেনা চীনের তৈরি এফএম-৯০ ক্ষেপণাস্ত্রই এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে কার্যকর ভূমি থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটি নিচু দিয়ে উড়া ড্রোন, হেলিকপ্টার, সাবসোনিক যুদ্ধবিমান ঠেকাতে সক্ষম হলেও, উচ্চগতির জেট বা দূরপাল্লার ক্রুজ মিসাইলের বিরুদ্ধে অকার্যকর।

২০১৮-২০২৩ সালের মধ্যে কিছু নতুন ক্ষেপণাস্ত্র সংযোজন করা হলেও সেগুলোর নাম বা সক্ষমতা সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

রাডার সিস্টেম:
  বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ২০২৫ সালে ফ্রান্সের থ্যালাস কোম্পানির তৈরি দুটি Ground Master 430 রাডার যুক্ত করেছে। এটি চতুর্থ প্রজন্মের এবং মোবাইল পর্যবেক্ষণের জন্য কার্যকর। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের থ্যালাস রাডারও সক্রিয়, তবে চট্টগ্রামের রাডারটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো।

যুদ্ধবিমান:
  বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে রয়েছে ৪৪টি যুদ্ধবিমান, যার মধ্যে ৩৬টি চীনের পুরনো এফ-৭। এছাড়া ৮টি সোভিয়েত যুগের মিগ-২৯ রয়েছে, যা চতুর্থ প্রজন্মের হলেও আধুনিক ফিফথ বা সিক্সথ জেনারেশন বিমানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। প্রশিক্ষণ ও হালকা আক্রমণে ব্যবহৃত ইয়াক-১৩০ রয়েছে ১৪টি।

ড্রোন ও হেলিকপ্টার

বাংলাদেশের বহরে বর্তমানে ৭৩টি হেলিকপ্টার রয়েছে, যার মধ্যে রাশিয়ার এমআই সিরিজের ৩৬টি, আর বাকিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সেসনা ও বেলের তৈরি। ড্রোনের ক্ষেত্রে রয়েছে ৪৪টি, ৩৬টি স্লোভেনিয়ার ভ্রামর C4-Eye এবং ৬টি তুরস্কের বায়রাকতার TB2।

বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও সুপারিশ

*মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, “বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা একেবারে জিরো না হলেও, জিরোর কাছাকাছি। আধুনিক প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে বর্তমানে ব্যবহৃত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর বলে মনে হয় না।”
  তিনি মনে করেন, প্রতিরক্ষা খাতে সৌন্দর্য বা প্রদর্শনীর চেয়ে বাস্তব সক্ষমতায় বিনিয়োগ জরুরি।

*এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন বলেন, “আজকের যুগে যুদ্ধ আকাশে শুরু হয়। যাকে স্কাই সুপিরিয়রিটি বলা হয়, যার আকাশ দখলে, সেই যুদ্ধে এগিয়ে থাকে।”
  তিনি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন, যা সমুদ্র সীমার ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নজরদারি করতে পারে।

*কর্ণেল (অব.) মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, “বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেটের খুবই অল্প অংশ আকাশ প্রতিরক্ষায় ব্যয় করা হয়। ভারতের মতো দেশে ইতোমধ্যে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে উঠেছে, যা বাংলাদেশে নেই।” তিনি একাডেমিক গবেষক ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের ওপর জোর দেন।

 

বাংলাদেশের সামরিক নীতি আক্রমণ নয়, প্রতিরক্ষা নির্ভর। কিন্তু সেই প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আকাশ প্রতিরক্ষার শক্তি বাড়ানো সময়ের দাবি। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু মাটির বাহিনী নয়, আকাশে শক্ত অবস্থানই নির্ধারণ করে বিজয়ী কে হবে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এখনই দরকার যথাযথ পরিকল্পনা, আধুনিকায়ন, বিনিয়োগ ও দক্ষ জনবল তৈরির সুসংহত উদ্যোগ।

 

 

সূত্র:https://youtu.be/zYLIgMlAhSY?si=s6FP-lh7oBZnhtAl

ছামিয়া

×